নাজমুল হক

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা হলো সড়ক দুর্ঘটনা, যার দরুন দিনের পর দিন মানুষ মরছে। আর এ সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ড্রাইভাররা। সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদী ঝড় তোলে সাধারণ মানুষ। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের জন্য রাস্তায় নামে এবং বেপরোয়া গাড়িচালকের ফাঁসি, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালনা বন্ধসহ ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন করে সড়ক পরিবহন আইনের জন্য জোর তাগিদ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত ২৯ সেপ্টেম্বরে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাস করেছে। কিন্তু এই আইনকে মেনে নিচ্ছে না পরিবহন শ্রমিকরা। তাই তারা এই আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করে আট দফা দাবিতে ধর্মঘট ডাকে। তাদের দাবিগুলো হলোÑসড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারা মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশ হয়রানি বন্ধ, ওয়ে স্কেলে জরিমানা আদায় ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।

বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে দুর্ভোগে নাকাল হয় দেশবাসী। পুরো দেশেই সকাল থেকেই শুরু হয় কর্মজীবী মানুষদের কর্মব্যস্ততা। যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ে গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য। কেউ ছোটে অফিসে, কেউ কলকারখানায়, কেউ বা নিজের প্রয়োজনে আবার শিক্ষার্থীরা ছোটে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বিকল্প পদ্ধতি না থাকায় হেঁটেই রওনা দিতে হয়েছে। কিছু রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশা থাকলেও তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া লুফে নেয়। কেউ কেউ বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যায় গন্তব্যস্থলে। অন্যদিকে, অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের মোটরসাইকেল চালকরাও অ্যাপে না গিয়ে চুক্তিতে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়। একদিকে ভোগান্তি, অন্যদিকে ভাড়া বেশি, এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

এবার আসি আসল কথায়, পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতি বা ধর্মঘট ডেকেছে, এটা খুবই ভালো কথা। কেন না শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার অধিকার সব মানুষেরই আছে। কিন্তু ধর্মঘটের নামে জনগণের সঙ্গে এ রকম অসভ্য আচরণ কেন? ধর্মঘটের নামে শ্রমিকরা অন্য চালকদের মুখে বা গাড়িতে মেখে দিয়েছে পোড়া মবিল ও কালো রং। আবার এদিক থেকে রেহাই পায়নি কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও। তাদের সাদা পোশাকেও ভড়িয়ে দিয়েছে কালি। কোথাও কোথাও যাত্রী বা সাংবাদিকদের সঙ্গে করা হয় চরম অসভ্যতা। মোটরসাইকেলের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া ও রিকশা উল্টে দেওয়াসহ ব্যক্তিগত চাবি কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে কোথাও কোথাও। এটা কেমন ধরনের নোংরামি? এ বিষয়ে পুলিশদের নীরব ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন? যাদের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, তারাই যদি চুপ থাকে, তাহলে বলতেই হয়, দেশ বেশিদূর এগিয়ে যায়নি। জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সকেও ছাড় দেয়নি তারা। হাসপাতালে সঠিক সময় নিয়ে না যাওয়ায় সাত দিনের শিশুটি মারা যায়। কী দোষ করেছিল এই শিশুটি? এই শিশু মৃত্যুর দায় কে নেবে? আপনারা কি নেবেন? যদি এই অ্যাম্বুলেন্সে আপনার কোনো সন্তান থাকত, তাহলে আপনি কি পারতেন এভাবে মেরে ফেলতে? অথচ নিরাপদ সড়কের জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন ডেকেছিল। আমরা তো শুনলাম না কোথাও অসভ্য আচরণ হয়েছে। তারা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা লেন তৈরি করেছিল। কিন্তু আপনারা করলেন তার উল্টোটা। সেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে থেকে আপনাদের শিখতে হবে মানবিকতা কাকে বলে। উল্লেখ্য, দেশের সব মানুষ শ্রমিকদের অনেক ভক্তি বা সম্মান করত, এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর ফলে সেই সম্মানটুকু নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছে শ্রমিকরা।

যে সময় বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও প্রবৃদ্ধিতে সমৃদ্ধি অর্জন করছে, সে সময়ে একদল অসাধু মানুষ উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে অনৈতিক দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছে। কিছু না হলেই মাঠে নামার প্রচেষ্টা। এই সাহস আসে কোথা থেকে? মানুষ হত্যা করবেন আর তার প্রতিবাদ করলে আপনারাই আবার চড়াও হবেন। কেন? আমাদের কি যৌক্তিক দাবি থাকতে পারে না?

বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থাকায় ধর্মঘটের কারণে শুরু হয় জনদুর্ভোগ। যদি এই সাধারণ শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে না পারে, তাহলে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কারা? যে আইন করা হয়েছে এটা বাস্তবায়ন করা আপনাদের আমাদের একান্ত দায়িত্ব। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ হত্যা না করে, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে না। তারপরও আপনাদের এত চিন্তা কেন? নাকি আপনারা প্রমাণ করতে চাইছেন, আপনারা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ হত্যা করে থাকেন। অনেক হয়েছে, এবার একটু থামুন। নিয়ন্ত্রণে আসুন, দেশের উন্নয়নে কাজ করুন, বেপরোয়া গাড়ি না চালিয়ে চোখকান খোলা রেখে চালান। আপনারাই পারেন দুর্ঘটনা রোধ করতে। তাই আইনকে মেনে নিয়ে আর আন্দোলন না ডেকে জনগণের দুর্ভোগ দূর করুন। আমরা চাই সড়কে ফিরে আসুক শৃঙ্খলা এবং সব ধরনের নৈরাজ্যের অবসান ঘটুক। সর্বোপরি যারা ধর্মঘটের নামে অনৈতিক কর্মকা- করে, তাদের শক্ত হাতে প্রতিহত করে দেশের মানুষকে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। তাহলে জনগণ পাবে মুক্তি, দেশের হবে উন্নতি।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close