এস এম নাজের হোসাইন

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

নিবেদন

প্রার্থীদের কাছে খোলা চিঠি

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যেই প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের অংশগ্রহণের ঘোষণা প্রদান করায় সাধারণ জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে রাজনৈতিক সংকট কেটে যাবে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় বেশ মনোযোগী। ভোটারদের দরজায় দরজায় ভোট প্রার্থনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী ৩০ ডিসেম্বর বহুল কাক্সিক্ষত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব প্রার্থী জনগণের জন্য নানা প্রতিশ্রুতি প্রদান করছেন। নির্বাচনী অঙ্গীকারনামা বা মেনোফেস্টো প্রণয়নের কাজ চলছে। এ অবস্থায় দেশের ১৬ কোটি অসহায় ভোক্তার দাবি তুলে ধরার জন্য আমার এ প্রয়াস। আশা করছি, সম্মানিত প্রার্থী ও তাদের নীতি নির্ধারকরা আমাদের মনবেদনার কথাগুলো শুনবেন এবং তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রতিফলন ঘটাবেন।

এটা সবাই স্বীকার করে থাকেন যে, দেশের ১৬ কোটি মানুষই ভোক্তা। যারা ব্যবসায়ী, সেবা প্রদানকারী তারা একটি পণ্য বা সেবার জন্য সরবরাহকারী হলেও অন্য সব পণ্য বা সেবার গ্রাহক। তারপরও ভোক্তা হিসাবে সাধারণ জনগণের কোনো অধিকার ক্ষুণœ, প্রতারিত বা হয়রানির সম্মুখীন হলে বা তাদের মনোবেদনা জানানোর সুযোগ নেই। যদিও বর্তমান সরকার ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। আশার কথা, সরকারের এ ধরনের অনেক আইন ও বিধি-বিধান থাকলেও অনেকগুলোর মাঠ পর্যায়ে কোনো কার্যকারিতা নেই। যেমন ধরি, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১। যা অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি এই আইনের বিধিমালা প্রণীত হয়নি। আইনটি কোন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ রেখা নেই। যা হোক এখন আসি নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে নিত্যদিনকার সমস্যা যা একজন নাগরিকের জীবনকে বারাংবার ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। বিশেষ করে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, গণপরিবহন, নিরাপদ খাদ্য, সুস্থ পরিবেশে বসবাস ও জীবনযাপন করার অধিকার। যদিও এই অধিকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্র তার জনগণকে তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

নগর জীবনে একটি বড় সমস্যা হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, মজুতদারী করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে থাকে। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন অনেক সময় নীবর থাকে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাজারগুলোতে নজরদারির পরিমাণ খুবই নগণ্য। স্থানীয় সরকারগুলোর ধারণা দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ। সে কারণে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের তদারকি করতে তারা আগ্রহী নয়। ফলে ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাই বাজারগুলোতে নিয়মিতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার দর মনিটরিং, বাজারে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রয়োজনে বাজার কমিটি, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, পুলিশ, চেম্বার, ক্যাব প্রতিনিধি, সাংবাদিক প্রতিনিধি সমন্বয়ে বাজারভিত্তিক মনিটরিং কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ময়লা আবর্জনা অপসরাণ ও পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা। কিন্তু এটি কোনো সময় যথাযথভাবে হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। কারণ পুরো নগরকে অনেক সময় মনে হয় ডাস্টবিনের মতো। সকালে রাস্তার পার্শ্বের ডাস্টবিনগুলোর ময়লা পরিষ্কারের বিধান থাকলেও অনেক সময় দুপুর গড়িয়ে তা সন্ধ্যাও হয়ে যায়। আর ময়লার দুর্গন্ধে রাস্তায় স্বাভাবিকভাবে চলা ফেরা করাও কঠিন হয়ে যায়। অন্যদিকে, নগরীতে সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এক একটি সংস্থা এক একবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধুলাবালির যন্ত্রণায় ঠিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। টিএন্ডটি খুঁড়ে রাস্তা ঠিক করার পর আবার ওয়াসা খুঁড়ে এবং তারা দীর্ঘদিন রাস্তুাগুলো খুলে রেখে যায়। সিটি করপোরেশন রাস্তার উন্নয়ন করবে, কিন্তু সেটা যেন বছরের পর বছর ধুলাবালির কারণ না হয় আর ময়লা আবর্জনা যেন রাস্তায় ধুলাবাালির কারণ না হয় তার প্রতিকার সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে। আর এ ধুলাবালির কারণে হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের প্রকোপ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এখনো পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোর সক্ষমতা অর্জিত হয়নি। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নালা থেকে বর্জ্যগুলো তুলে রাস্তায় স্তূপ করে রেখে চলে যায়। আর একটি পক্ষ এসে এগুলো অপসারণ করতে অনেক সময় নিয়ে থাকে। ফলে ময়লাগুলো যেখান থেকে উত্তোলন করা হয় সেখানেই পুনরায় চলে যায়।

জলাবদ্ধতা শহর এলাকার জন্য একটি বৃহৎ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নালা নর্দমাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করা ও অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে যায়। নালার ওপর দোকান, অবৈধ স্থাপনা, নালা-নর্দমগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করার কারণে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা জলজট রূপে পরিণত হয়। আবার নগরীতে বাড়ি-ঘর তৈরিতে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ না রেখে বাড়ি তৈরি অনুমোদনও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। উন্নত রাষ্ট্রগুলো বৃষ্টি বাদল হলেই পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। আমাদের এখানে সে ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীতে যানজট এখন মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিরোধী দলের ডাকা হরতালেও ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের জন্য যত্রতত্র পার্কিং, গণপরিবহনের সংখ্যা কম, গণপরিবহনগুলোর অব্যবস্থাপনা, নগরে যাত্রী পরিবহনে ট্রেনের অনুপস্থিতি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোত পার্কিং সুবিধা না থাকা, লক্কড়ঝক্কড় বাস ও গণপরিবহনগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়া, ট্রাফিক বিভাগে সুষ্ঠু সমম্বয় না থাকা, পর্যাপ্ত বাসস্ট্যান্ড না থাকা অন্যতম। যার কারণে সাধারণ নাগরিকদের কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যদি নগরে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তৈরি হয় তাহলে মানুষ নিজস্ব পরিবহন বাদ দিয়ে গণপরিবহনে ভ্রমণে আগ্রহী হবে। আর লক্কড়ঝক্কড় যাই হোক না কেন বাড়তি ভাড়া আদায়, যাত্রী হয়রানি প্রতিরোধে নেই কোনো ব্যবস্থা। মেট্রো আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন কমিটিগুলো অনেকটাই পরিবহন শ্রমিক মালিক ও সরকারি সংস্থারগুলোর দেনদরবার কমিটির মতো সেখানে ভোক্তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই।

দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নেই। যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সকল জনগণ বলা হলেও বর্তমানে শাসন ব্যবস্থায় সমাজের সকল পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। শুধু জনপ্রতিনিধি নির্বাচন বা ভোট দেওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। যদিও ইতিপূর্বে সে ভোটাধিকারও ছিল না। এখন ভোট নেওয়ার পর জনপ্রতিনিধিরা আর জনগণের তোয়াক্কা করে না। কথায় কথায় তারা বলেন, আমরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত। এটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। এ জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়। যেখানে অনেকগুলো খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নীতি নির্ধারণ করে থাকেন, আবার অনেক জায়গায় সরকারি কর্মকর্তা ও ঐ সেক্টরের ব্যবসায়ীরা মিলে নীতি নির্ধারণ করে থাকেন। অথচ এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এই সেবা সার্ভিস তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এ সমস্ত পদগুলোও সমাজের ওপরতলার লোকজন দখল করে নেন। নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যার জন্য এই সেবা বা বিধান তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না। ব্রিটিশ আমলের ঘুনে ধরা আমলাতন্ত্রের সংস্কার ব্রিটিশরা করতে পারলেও বাংলাদেশ তা এখনো পারেনি। যার কারণে সেবাদানকারী সংস্থা ও নাগরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কমিটিতে এখনো সেই ব্রিটিশদের নির্দেশিত পথেই হাঁটছে। যার কারণে ভোক্তা ও নাগরিক সংশ্লিষ্ট কমিটি ও সেবাদানকারী সংস্থায় এখনো সত্যিকারের ভোক্তা প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। যদিও কোনো জায়গায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে সেখানে সভাপতি কর্তৃক মনোনীত বলে আরো খাটো করা হচ্ছে।

তাই এখন সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার। বিশেষ করে সরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রশাসনিক ও আর্থিক জবাবদিহিতাকে নাগরিক তদারকি ও পরীবিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। নাগরিক স্বার্থ সাংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নাগরিক সংগঠনগুলোকে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি নাগরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কমিটি ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দান এবং এ সমস্ত নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাড়িভাড়া, হোল্ডিং ট্যাক্স, গণপরিবহন, নগর ব্যবস্থাপনা, শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে নাগরিক ভোগান্তি নিরসনে গ্রাহক, সেবাদানকারী সংস্থা ও ভোক্তা প্রতিনিধি, প্রশাসনের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় গণশুনানির ব্যবস্থা করার সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দানকারীকে জয়যুক্ত করতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যাব

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close