রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ঘন কুয়াশায় ঢাকা শ্রীলঙ্কার রাজনীতি

নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে এবং পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে উভয়েই দাবি করছেন সংসদে আস্থা ভোটে জিতে আসবেন। তবে সংসদের আস্থা ভোটে জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। যিনি ওই আস্থা ভোটে পরাজিত হবেন, তিনি সহজভাবে পরাজয় মেনে নেবেন না। আর প্রেসিডেন্ট স্বয়ং রাজাপাকসের পক্ষে। কাজেই রাজাপাকসেকে জিতিয়ে আনতে সম্ভব সবকিছু করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। কাজেই দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট কমবে না বরং আরো গভীরতর হবে। আরো অন্তত তিনটি কারণে রাজাপাকসেকে জিতিয়ে আনা হতে পারেÑ তাহলো চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব। রাজাপাকসে চীনাপন্থী বলে খ্যাত। অন্যটি হলো, অতীতের গৃহযুদ্ধের সময়কালে মানবতাবিরোধী যুদ্ধপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। রাজাপাকসের সময়েই এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল এবং তার ভাইয়েরা এ অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। শেষটি হলো; ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন। আসন্ন ওই নির্বাচনে জিতে আসার জন্যও রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী পদের আস্থা ভোটে জিতে আসার নানা কৌশল নেবেন। কারণ তিনি ওই পদে থাকলে ২০১৯ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাইথ্রিপালা সিরিসেনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তখনকার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে।

এক সময় সিরিসেনা রাজাপাকসের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। কিন্তু রাজাপাকসের সর্বাত্মকবাদী শাসননীতির সঙ্গে দ্বিমত করেই মন্ত্রিসভা ও রাজাপাকসের রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন সিরিসেনা এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের প্রতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জনগণের ভোটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। যে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করেছিলেন সিরিসেনা সেই পার্টির প্রধান নেতা ছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে রনিল বিক্রমাসিংহেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য হলো এই যে, সিরিসেনা এবং বিক্রমাসিংহে এখন দুই মেরুর বাসিন্দা। বছর চারেক আগে দুই নেতা এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন একটি স্বৈরশাসকের পতন নিশ্চিত করার জন্য এবং তারা বিজয়ী হয়েছিলেন। আর বছর চারেকের ব্যবধানে স্বৈরশাসকবিরোধী মৈত্রী জোটের অংশীদার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আচমকাভাবে পদচ্যুত করে ২০১৫ সালের চরম শত্রুভাবাপন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পরাজিত রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা এটি প্রমাণ করলেন যে, রাজনীতি আর ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারায় স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে তার পদ থেকে পদচ্যুত করার ঘটনাটিকে সাংবিধানিক ক্যু হিসেবে অভিহিত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন দেশটির সংবিধান প্রেসিডেন্টকে এমন ক্ষমতা দেয়নি। ২০১৫ সালে দেশটির সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য পদে অযোগ্য হলে, সংসদ সদস্য পদ বহাল না থাকলে, মৃত্যু বা স্বেচ্ছায় সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করলে, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করলে বা সংসদে আস্থা ভোটে পরাজিত হলে একজন প্রধানমন্ত্রীর পদশূন্য ঘোষিত না হলে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত বা পদচ্যুত করতে পারবেন না। অর্থাৎ ১৯তম সংবিধান সংশোধনী দ্বারা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত বা পদচ্যুত করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। অথচ প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সাংবিধানিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করে রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়ে সাংবিধানিক ক্যু করেছেন বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। আইনত ২২৫ সদস্যের শ্রীলঙ্কান আইনসভার আস্থা না হারানো পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের নেই। তা সত্তেও প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এখন অবধি দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার রয়ে গেছেন বরখাস্তকৃত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখলে রেখে নিজেকে দেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করছেন।

অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করে দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় এখন প্রধানমন্ত্রী দুজন। উভয় প্রধানমন্ত্রীর পেছনে দেশটির সাধারণ জনগণের সমর্থন রয়েছে বিধায় জনগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিধায় সংঘাত প্রায় নিশ্চিত বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের এলান কিনান মনে করেন দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

রাজাপাকসের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ প্রদান করাটা অসাংবিধানিক এবং এর ফলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলো এবং এ কারণে দেশটি অস্থিতিশীল হবে বলে অভিমত দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ। আন্তর্জাতিক এ গ্রুপটি মনে করে রাজাপাকসের ক্ষমতায় ফিরে আসার কারণে শ্রীলঙ্কা পুনরায় সংঘাত, সংঘর্ষ ও সংকটময় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবারও দেশটিতে বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক সমালোচকের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসতে পারে। রাজাপাকসের পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন লংকান জনগণের বড় অংশের কাছেই একটি অশনিসংকেত হিসেবে গণ্য হয়েছে। বিশেষ করে তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রাজাপাকসের দীর্ঘ শাসনকালে অর্থাৎ ২০০৫-১৫ মেয়াদে ১০ বছরের শাসনকালে রাজাপাকসের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তার সমালোচক ও তামিলভাষী মানুষের কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক।

রাজাপাকসে তার দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলে নিজেকে দেশটির একক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং তার পথের বিরোধিতাকারী রাজনীতিক, ভিন্নমতের অধিকার কর্মী, ভিন্ন মতের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে ভয় দেখানো হতো, জেলে পাঠানো হতো, নয়তো গুপ্তহত্যার দ্বারা তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো। তিনি সব ধরনের গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। এখন আবার তার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের ফলে পুনরায় অত্যাচার-নির্যাতন, গুম, খুনের মাধ্যমে ভিন্নমত দমনের চেষ্টা করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে পুনরায় দুঃশাসন নেমে আসতে পারেÑ এমনটাই মনে করছেন অধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও বিরোধী মতের লোকেরা। তামিলদের জন্য রাজাপাকসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এক মহাদুর্যোগ বলে মনে করছেন তামিলভাষী শ্রীলঙ্কানরা। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কায় সিংহলী এবং তামিল দুইটি বড় সম্প্রদায়। এর মধ্যে তামিল সম্প্রদায় পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য তামিল লিবারেশন ফোর্স বা এলটিটিই গঠন করে সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করেছিল। ২৬ বছর ধরে চলমান এ যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল মাহিন্দা রাজাপাকসের প্রেসিডেন্সিকালে। রাজাপাকসে প্রচন্ড সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন তামিলদের বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে তামিল স্বাধীনতাকামী এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের মধ্যেকার যুদ্ধে কয়েক লাখ তামিলকে হত্যা করে তামিল বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল। এ কারণে তামিল ভিন্ন মতাবলম্বীরা রাজাপাকসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকে তামিলদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বলে মনে করছেন।

উল্লেখ্য, তামিলদের ভয়ার্ত মনের আভাস পাওয়া যায় ওয়াশিংটনভিত্তিক পিপল ফর ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড রিলিফ ইন শ্রীলঙ্কার অ্যাডভোকেসি পরিচালক মারিও আরুল থাসের লেখা থেকে। আল জাজিরায় নিবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেন, ‘২০০৯ সালে তারা আতশবাজি পুড়িয়েছে, যখন আমরা ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম। আজ আবারও তারা উদ্যাপন করছে, যখন আমরা নিজেদের এমন একটি ভয়ের সঙ্গে পরিচিত করে তুলছি-যা অতীতেরটাকে স্মরণ করার কাছাকাছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মনে হয় সম্ভবত আমাদের আবারও ঘর বন্ধ করে থাকতে হবে।’

রাজাপাকসের প্রত্যাবর্তন শুধু তামিলদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেনি। দেশটির সব ভিন্ন মতের লোকদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দেশ ও বিদেশের পর্যবেক্ষকরাও সহিংসতার আশঙ্কা করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতি সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোও শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিপন্ন হতে পারে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close