নিতাই চন্দ্র্র রায়

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য খেজুরের গুড়

খেজুরের গুড় বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। খেজুরের গুড় ছাড়া শীতকালে পিঠা-পায়েশ তৈরির কথা ভাবাই যায় না। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে খেজুরের গুড় তৈরির ধুম পড়ে যায়। গাছিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে রস সংগ্রহ, রস জ্বাল ও গুড় তৈরির কাজে। আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে খেজুরের গাছের রোপণ খুব কমই হয়। তবে রাস্তার ধারে, বাড়ির আশপাশে, জমির আইলে, পুকুর পাড়ে, রেললাইনের পাশে পরিত্যক্ত স্থানে অযতœ-অবহেলায় খেজুরগাছ জন্মাতে দেখা যায়। খেজুরগাছ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, যা থেকে প্রতি বছর কৃষক গুড় তৈরির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে এই বন্য প্রজাতির গাছটির চাষ হলেও যশোর এবং নাটোর জেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুরের চাষ হয়ে থাকে। বৃহত্তর রাজশাহী, ফরিদপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের অন্য জেলাগুলোয়ও প্রচুর পরিমাণে খেজুরের গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে।

খেজুরের রসে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ শর্করা বিদ্যমান, যা থেকে উন্নত মানের সুস্বাদু গুড় ও সিরাপ তৈরি করা হয়। খেজুরের গুড় আখের গুড়ের চেয়ে অধিক মিষ্টি ও পুষ্টিকর। এ ছাড়া খেজুরের গুড় সুন্দর ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য প্রসিদ্ধ। খেজুরের গুড়ে আখের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। শীতকালে গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রস একটি জনপ্রিয় পানীয়। এ ছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মিঠাই, মন্ডা, সন্দেশ ও রকমারি পিঠা প্রস্তুত করা হয়। খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা ও পায়েশ খুবই সুস্বাদু। খেজুরগাছ থেকে বেশি পরিমাণে গুড় উৎপাদনের জন্য এদের পরিচর্যা প্রয়োজন। সতেজ গাছ থেকে বেশি পরিমাণে রস পাওয়া যায়। খেজুরগাছে বছরে দুবার সার প্রয়োগ করতে হয়। রস আহরণ শেষে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে একবার এবং শীতকাল শুরু হওয়ার আগে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে আর একবার। প্রতিবার গাছের বয়স ভেদে ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম টিএসপি ও ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পটাশ সার গাছের চারপাশে প্রয়োগ করলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া সময়মতো গাছের চারপাশের আগাছা দমন করা উচিত। যেহেতু খেজুরগাছের শিকড় মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে, তাই বাঁশের খুঁটি দিয়ে চারপাশে ৩ থেকে ৪টি গর্ত করে উল্লিখিত পরিমাণ সার একসঙ্গে মিশিয়ে গর্তের ভেতর দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। খেজুরের পুরুষ ও স্ত্রী উভয় প্রকার গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে স্ত্রী গাছের তুলনায় পুরুষ গাছে রস কম হয়। তবে পুরুষ গাছের রসে চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। রস সংগ্রহের জন্য কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের সুস্থ ও সবল গাছ নির্বাচন করতে হবে। যেসব গাছ দেখতে সুস্থ ও সবল, সেসব গাছ নির্বাচন করলে অধিক রস পাওয়া যায়। গাছির দক্ষতা ও গাছ কাটার ওপরও রস সংগ্রহ অনেকটা নির্ভর করে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গাছের বেড়ের এক-তৃতীয়াংশ অংশ লম্বা ও ৭ দশমিক ৫ সেমি প্রস্থ করে গাছ কাটলে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায় এবং গাছের কোনো রকম ক্ষতি হয় না। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করতে হয়। গাছ পরিষ্কার করার পর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন গাছ কাটতে হয়, যাতে গাছে রস নিঃসরণ শুরু হয়। কোনো কোনো গাছ কাটা শুরুর ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই রস নিঃসরণ শুরু হয়। এরপর কাটা অংশের যেখানে রস নিঃসরণ শুরু হয়, সেখানে একটি ইউ আকৃতির চিকন বাঁশের কাঠির আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে দিতে হয়। ইউ আকৃতির কাঠির মধ্য দিয়ে রস ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের ঝুলন্ত হাঁড়িতে জমতে থাকে। তবে গাছ একবার কাটলে ৩ থেকে ৪ দিন রস সংগ্রহ করা উচিত এবং পরবর্তী ২ থেকে ৩ দিন গাছ শুকাতে হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে গাছ দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক একটি গাছে নভেম্বর মাস থেকে মধ্য মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে দৈনিক ১০ থেকে ২০ লিটার রস পাওয়া যায়। রস সংগ্রহের পর প্রতিবার হাঁড়ি ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হয়। এতে সংগৃহীত রস গাজানো বন্ধ থাকে। অনেক সময় কাঠ বিড়ালি, বুলবুলি, কাক, বাদুর ইত্যাদি পাখি খেজুরের হাঁড়িতে বা রসের নলে বসে রস খায়। এসব পাখির মাধ্যমে যাতে কোনো রোগ জীবাণু ছড়াতে না পারে, সে জন্য গাছে হাঁড়ি ঝোলানোর সময় হাঁড়ির মুখ জাল বা নেট দ্বারা ঢেকে দিতে হয়।

স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নতমানের খেজুরের গুড় বা সিরাপ উৎপাদনের জন্য রস সংগ্রহের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে রস ছেকে চুলার ওপর বসানো লোহার বা স্টিলের কড়াইয়ে ঢালা হয়। চুলার ওপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কড়াই ও চুলার মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। আরো খেয়াল রাখতে হবে যেন চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে কড়াইয়ের রসের সঙ্গে মিশতে না পরে। রস জ্বাল দেওয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ ভেসে ওঠে, তা দ্রুত সম্ভব ছাকনি বা হাতা দিয়ে ফেলে দিতে হবে। তারপর রস ঘনীভূত হলে ঘনীভূত রস হাতা দিয়ে অল্প তুলে ফোঁটা ফোঁটা করে ফেলে দেখতে হবে শেষের ফোঁটার আঁঠালো ভাব দেখা যায় কি না। ঘনীভূত রস আঁঠালো বা সিরাপের মতো দেখা গেলে তা নামিয়ে সিরাপ তৈরি করতে হবে। গুড় তৈরি করতে চাইলে কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতারভাবে নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। গুড় তৈরির জন্য চুলা থেকে ঘনীভূত রস নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে এক চিমটি পরিমাণ গুড় কিছু ঠা-া পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। গুড় দ্রুত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে দ্রুত ঠা-া করতে হবে।

শীত মৌসুমে সংরক্ষিত গুড়ে তেমন ক্ষতি না হলেও বর্ষা মৌসুমে সংরক্ষিত গুড়ের প্রায় ৩০ ভাগই খাবার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। অর্ধ তরল প্রকৃতির গুড় সচরাচর মাটির বড় বড় পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ তুলনামূলকভাবে খরচ কম বিধায় অধিকাংশ গুড় ব্যবসায়ী মাটির পাত্রে গুড় সংগ্ররক্ষণ করে থাকেন। কোনো কোনো এলাকায় ২০ কেজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন টিনের পাত্রে গুড় সংরক্ষণ করা হয়, তবে এই পদ্ধতি কিছুটা ব্যয়বহুল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রং করা মাটির পাত্রে মোম বা পলিথিন দিয়ে মুখ বন্ধ করে গুড় সংরক্ষণ করলে দীর্ঘদিন গুড় ভালো থাকে।

৫০ থেকে ৬০টি খেজুরগাছের একটি বাগান থেকে রস সংগ্রহ করে সিরাপ বা গুড় তৈরি করে একজন গুড় উৎপাদনকারী ৫ থেকে ৬ সদস্যের একটি পরিবারেরর সারা বছরের ভরণপোষণ মেটাতে পারে। বাংলাদেশে হাইওয়ে আছে ২ হাজার ৫০০ মাইল, গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার মাইল, ইট বিছানো রাস্তা রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মাইল। নিয়মিত বাঁধ ও বেড়িবাঁধ রয়েছে প্রায় ১০ হাজার মাইল। মিটার গেজ রেলপথ রয়েছে ১২০০ মাইল ও ব্রডগেজ রেলপথ রয়েছে ৬০০ মাইল। এই ১ লাখ ৬ হাজার মাইল রাস্তার দুই ধারে ১৫ ফুট দূরে দূরে অব্যবহৃত জমির ১-৪ অংশে লাগানো সম্ভব হলেও ১ কোটি ৪৫ লাখ খেজুরগাছ লাগানো সম্ভব। এ ছাড়া বরেন্দ্র এলাকায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির আইল ও রাস্তার দুধারে পুকুর ও খালের পাড়ে কয়েক কোটি খেজুরগাছ লাগানো সম্ভব। প্রতি বছর যদি এক কোটি গাছ থেকে গড়ে ১০ কেজি হিসেবে গুড় উৎপাদন করা সম্ভব হয়, তবে এক লাখ টন খেজুরের গুড় উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৬০ টাকা হিসেবে ৬০০ কোটি টাকা। খেজুরের চাষ বৃদ্ধি, উন্নতব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসম্মত সিরাপ ও গুড় উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের চিনি ও গুড়ের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে। বিদেশে খেজুরের গুড়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। তাই সিরাপ ও গুড় প্রস্তুত কুটিরশিল্প হিসেবে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে। দামে সস্তা হওয়ার কারণে এক শ্রেণির অসাধু ইটভাটার মালিক ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ধ্বংস করছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হাজার হাজার খেজুরগাছ। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় খেজুরগাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে দেশ থেকে। তাই এ ব্যাপারে এখন থেকেই সরকারিভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে খেজুরগাছ নিধনের মতো গর্হিত কাজ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close