রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৪ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ

বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রসমূহ এবং অন্য দেশগুলো আইএনএফ চুক্তি বাতিলের ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, রাশিয়া আইএনএফ চুক্তির কোনো ধারা লঙ্ঘন করেনি। এমতাবস্থায় তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ট্রাম্পের পরমাণু চুক্তি বর্জনের সিদ্ধান্তে পৃথিবী এখন নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা পড়েছে। তিনি আরো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আইএনএফ চুক্তির ভিত্তিতেই অবজ্ঞাভরে নড়বড়ে করে দিয়েছে। অথচ মস্কো কখনো এ চুক্তিকে লঙ্ঘন করেনি এবং ভবিষ্যতেও রাশিয়া এ চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। এর আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, মস্কোকে পারমাণবিক হুমকি দিলেও দেশটি কখনো পরমাণু অস্ত্রের প্রথম আক্রমণকারীর বদনাম গ্রহণ করবে না। এমনকি পরমাণু যুদ্ধ বাঁধলেও রুশরা শহীদ হয়ে স্বর্গে যাবে। সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এক মন্তব্যে বলেন, আইএনএফ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রজ্ঞার অবক্ষয় এবং মারাত্মক ভুল। অনেকে প্রত্যাশা করেছিলেন, গত ২০ অক্টোবর ট্রাম্পের আইএনএফ চুক্তি বর্জনের পরের দিন ২১ অক্টোবর তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনের রাশিয়া সফরকালে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও অন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর হয়তো বৈশ্বিক উদ্বেগ কিছুটা হ্রাস পাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। ইতোমধ্যে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় দেশটি অস্ত্রের গুদাম গড়ে তুলবে।

ট্রাম্প দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, রাশিয়া, চীনসহ অন্য কোনো রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ করলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অস্ত্রভা-ার সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কর্তব্য হলো বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রতি তাদের প্রেসিডেন্টের সৃষ্টি করা হুমকি প্রশমিত করার উদ্যোগ নেওয়া। আইএনএফ চুক্তি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণার কারণ হিসেবে ট্রাম্প রাশিয়া ও চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। তার মতে, চীন যেহেতু আইএনএফ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ নয়, কাজেই দেশটি স্বাধীনভাবে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেন, ট্রাম্পের আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘনের সঙ্গে চীনকে জড়ানো সঠিক নয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ ঘোষণা থেকে আঁচ করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আইএনএফ চুক্তি বর্জনের কারণে চীনও তার অস্ত্রসম্ভার বাড়াতে সচেষ্ট হবে এবং পরমাণু অস্ত্র চুক্তির ফলে যে বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিনষ্ট হবে। এ মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইইউ অত্যন্ত সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র মাজা কোচিজানেচ্চি মনে করেন, আইএনএফ চুক্তির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু চুক্তি হেফাজতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উচিত আরো নিবিড় আলোচনায় বসা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নানা উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছেন। গত ২০ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১৯৮৭ সালে দুই পরাশক্তি স্বাক্ষরিত ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি (আইএনএফ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় নতুন হুমকি তৈরি করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ও সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ তিন দশক আগে যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তাতে বলা হয়, যেকোনো দেশ ৩১০ থেকে ৩৪০০ মাইল দূরে আঘাত হানতে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে না। দুই পরাশক্তি গত বছরগুলোয় ওই আইএনএফ চুক্তির শর্ত মেনে চলেছে এবং কোনো পক্ষ থেকে তেমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এ চুক্তির ব্যাপারে পরস্পরকে অভিযুক্ত করে আসছে। মস্কোর অভিযোগ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে আইএনএফ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ হলো পশ্চিমাদের নিশানা বানিয়ে রাশিয়া ‘৯ এম ৭২৯’ মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা ৩১০ মাইলের চেয়ে বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। দুই পারমাণবিক শক্তির রাষ্ট্র দুটির এ পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আইএনএফ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে দিয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অস্থিরতায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যে শ্বাসরুদ্ধকর নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হয়েছিল, ষাটের দশক পার হতে না হতেই তা স্তিমিত হতে থাকে। তদানীন্তন পরাশক্তিদ্বয়ের দাঁতাত ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি স্নায়ুযুদ্ধের ভয়ংকর থাবা থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এমন সময় এনপিটি, সল্ট, আইএনএফ, স্টার্ট নামক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিসমূহ স্বাক্ষরিত হয় এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও তা থেকে উদ্গীরিত পারমাণবিক যুদ্ধ হুমকি থেকে বিশ্ববাসী বেশ নিষ্কৃতি পায়।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক এক করে আবার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় সৃজিত পারমাণবিক অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন। ক্রিমিয়া ইস্যুকে পুঁজি করে তিনি ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য ও অস্ত্র বৃদ্ধির নীতি অনুসরণের কথা বলেছিলেন। তখন বোঝা যাচ্ছিল, শিগগিরই তিনি বিশ্বকে আবার পারমাণবিক হুমকিতে বিদ্ধ করবেন। এরপর তিনি ইরানের সঙ্গে পঞ্চশক্তি এক দেশগুলোর স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তদন্ত সংস্থা জাতিসংঘের তদন্ত মিশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রহরা ও সংস্থাসমূহ যদিও ইরানের পারমাণবিক চুক্তির ধারা পুরোপুরি মেনে চলার প্রমাণ দিতে থাকে, তবু ট্রাম্প অভিযোগ করেন, ইরানের সঙ্গে ওই চুক্তিটি সঠিক ছিল না এবং একপর্যায়ে তিনি সে চুক্তি বাতিল করেন। এ মুহূর্তে বৈশ্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে আরো কথাবার্তা বলার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজি করানো। মস্কো সফররত জন বোল্টন এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রয়োজনে চীনসহ অন্যান্য পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিগুলো নতুন করে লেখা দরকার। যাতে বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে প্রয়োগ করা যায়। পারমাণবিক অস্ত্রায়ন নয়। বরং পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করবে, এ সত্য ট্রাম্পকে বুঝতে হবে এবং বিশ্বশান্তি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত নেতৃত্বদানে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চলছে। এ অবস্থা দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সেই বিশ্বনেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই এখন বিশ্ব পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়বে। রাশিয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করবে আগ্রাসী মূর্তিতে। চীনও সে প্রতিযোগিতায় দূরে থাকবে না। এ সুযোগে ইরান, ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারতও পারমাণবিক অস্ত্র গুদাম তৈরিতে উদ্দীপিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোও তাদের অর্থসম্পদ ব্যয় করবে পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড় জমাতে। সৌদি যুবরাজ বিন সালমান ইতোমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ক্রয় ও অস্ত্র তৈরির ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, পরমাণু অস্ত্র-সংক্রান্ত চুক্তিসমূহের কারণে বিশ্বের রণকৌশলগত ভারসাম্য টিকে আছে এবং বিশ্ব নিরাপত্তা মোটামুটি বজায় থাকছে। কিন্তু ট্রাম্পীয় নীতির কারণে আবার বিশ্ব পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারে কেঁপে উঠবে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যাহত হবে বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন। অনেকের মতে, বিশ্ব এখন পারমাণবিক অস্ত্র মহড়া ও পারমাণবিক যুদ্ধ দামামার সম্মুখীন। আইএনএফ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং স্নায়ুযুদ্ধকালীন পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেন। ইউরোপের নিরাপত্তা ও রণকৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য দুই পরাশক্তির পরমাণু অস্ত্র চুক্তির অনস্বীকার্যতা তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। এতদসত্ত্বেও কি ট্রাম্প তার পারমাণবিক অস্ত্রায়নের উচ্চাভিলাষ পরিত্যাগ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতির গতিবিধি বিশ্লেষণ করে বলা যায় বিশ্বকে নিরাপত্তাহীন করতে ট্রাম্পীয় নীতি থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close