সাধন সরকার

  ১৩ নভেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

শব্দসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ

শব্দদূষণ নামের নীরব ঘাতক রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ‘শব্দসন্ত্রাসে’ রূপ নিয়েছে। ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে যেখানে-সেখানে যানবাহনে হর্ন বাজানোর ওপর বিধি-নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, পথে ট্রাফিক জ্যাম থাকলেও অযথা হর্ন বাজানো হচ্ছে। অনেক সময় চালকরা আবার ইচ্ছা করে হর্ন বাজাচ্ছে! মোটরসাইকেলগুলোর কারণে-অকারণে হর্ন বাজানোর কারণে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। মোটরসাইকেলসহ রাজধানীর অনেক যানবাহনে এখনো ‘হাইড্রোলিক হর্ন’ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্ট যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশনা আছে। কিন্তু কেউ এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না। মূলত আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে যেখানে-সেখানে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহর করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে যানবাহন চলার সময় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। শব্দদূষণ নামের এই মারাত্মক সমস্যা মূলত মানুষেরই সৃষ্টি। যারা শব্দদূষণ করছে, তাদের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি তো কাজ করছেই না, আবার কেউ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে অনুরোধ করলে বা প্রতিবাদ করলে হিতে বিপরীত আকার ধারণ করছে! যদিও এই পরিবেশগত সমস্যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। শব্দদূষণের বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ, বিভিন্ন অবকাঠামো-নির্মাণকাজের শব্দ, মিছিলে কিংবা অন্যান্য কাজে মাইকের অতিরিক্ত শব্দ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শহরে বাসার ছাদে ব্যান্ডসংগীতের আয়োজন, কলকারখানার শব্দ ইত্যাদি। হর্ন-মাইকের বিরক্তিকর শব্দ মানুষের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে হর্ন-মাইকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আমাদের দেশে যেখানে-সেখানে এই মাইকের ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটা, রাতের ঘুম নষ্ট হওয়াসহ জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, রাজধানীতে শব্দের মাত্রা এর ‘মানমাত্রার’ চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বৈশ্বিক এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের শিশুদের কানের সমস্যা বিশ্বের যেকোনো দেশের শিশুদের চেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বসতি এলাকায় দিনের বেলা ও রাতে শব্দমাত্রা হওয়া উচিত যথাক্রমে ৫৫ ও ৪৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৬৫ ও ৫৫ ডেসিবেল। শিল্পাঞ্চলে দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৫ ডেসিবেল। এ ছাড়া হাসপাতালের মতো নীরব এলাকায় শব্দমাত্রা হওয়া উচিত দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল। শব্দের মাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে অর্থাৎ মানুষের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলে তাকে ‘শব্দদূষণ’ বলে গণ্য করা হয়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ যদি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনেক দিন ধরে নিরুপায় হয়ে শুনতে হয় তাহলে শরীর ও মনে তার প্রভাব তীব্রভাবে পড়ে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরের বিভিন্ন এলাকাকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪০ থেকে ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে। অথচ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্ধারিত মানদ-ের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে তিন গুণেরও বেশি হচ্ছে! বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬’ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালা অনুসারে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদগু বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদগু অথবা উভয় দগু এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদগু বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদগু অথবা উভয় দগেু দগিুত হওয়ার বিধান রয়েছে। আবার ‘মোটরযান আইন-১৯৮৮’-এর ১৩৮ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা মোটরগাড়ির মালিক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মোটরযানে এমন ধরনের হর্ন বা শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র সংযোজন বা ব্যবহার করেন, যা সংশ্লিষ্ট এলাকায় যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ এ আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করেছে কিংবা কোনো নিদিষ্ট স্থানে অনুরূপ হর্ন বা যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে, তবে সর্বোচ্চ ১০০ পর্যন্ত টাকা জরিমানা হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার নেই, এর থেকে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, আলসার, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, হৃদরোগ, বধিরতাসহ সর্বোপরি শরীর ও মনে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এমনকি মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি তাদের শ্রবণশক্তিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া শিশুর বেড়ে ওঠা ও মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শব্দদূষণে। অসুস্থ ব্যক্তিরাও শব্দদূষণে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগ মানুষ কানে কম শুনবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ৬০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে অস্থায়ী বধির এবং ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে স্থায়ীভাবে বধির করে দেয়। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু এসব আইন কি মানা হচ্ছে? রাজধানী ঢাকা বা শুধু বিভাগীয় শহর নয়, জেলা ও উপজেলা শহরগুলোয়ও শব্দদূষণ বেড়েই চলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে কাজ করা বেশির ভাগ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বধির হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সবদিক বিবেচনায় ঝুঁকি ও দূষণমুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও নিরাপদ জাতি গঠনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আইনের যথাযথ পদক্ষেপ ও সামাজিক সচেতনতা না থাকায় হর্ন বাজানো বা শব্দদূষণের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যানবাহনের চালক ও মালিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পথেঘাটে, যেখানে- সেখানে হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর; এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের হাতে শব্দের মাত্রা মাপার যন্ত্র দেওয়া হলেও তার ব্যবহার সচারচর দেখা যায় না। এ ছাড়া রাস্তায় যানজট থাকলেও যেসব চালক অযথা হর্ন বাজায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে শব্দের মাত্রা পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে আরো সক্রিয় হতে হবে। ঢাকা শহরটা এমনিতেই ছোট। অনেক সময় আবার বোঝারও উপায় থাকে না কোনটা আবাসিক, নীরব, অথবা বাণিজ্যিক এলাকা। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বাসাবাড়ি রাস্তা বা অলিগলির সঙ্গে বা পাশে অবস্থিত। এ ব্যাপারে যানবাহনের চালকদের হর্ন ব্যবহারে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। ঢাকার রাস্তার প্রতিটি স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শব্দমাত্রার সতর্কতামূলক দিকনির্দেশনা ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে করে চালকরা হর্ন ব্যবহারে আরো সতর্ক হবে। পাশাপাশি নির্দেশনা অমান্য করলে চালকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা দূর করতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো সামাজিক সচেতনতা। সামাজিকভাবে সব ধরনের চালক ও সাধারণ জনগণ যত সচেতন হবে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা তত সহজ হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close