আবু আফজাল মোহা. সালেহ
মতামত
নীরব ঘাতক
শব্দঝড়ের ফলে তৈরি হওয়া বায়ুর চাপ বহু ক্ষেত্রে সজোরে কানে আছড়ে পড়ে ক্ষতি করে শ্রবণযন্ত্রের। শব্দদানবের দাপাদাপিতে হারিয়ে যায় উচ্চ তরঙ্গের (হাই-ফ্রিকোয়েন্সি) ধ্বনি। চিকিৎসক-গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছে, শব্দবাজির দাপটে ব্যঞ্জনধ্বনি শোনার অভিজ্ঞতাই বদলে যাচ্ছে বহু ভুক্তভোগীর। শব্দবাজি বা শব্দদানবের আওয়াজ নির্দিষ্ট পরিসরে বায়ুর চাপ বাড়িয়ে দেয়। এতটাই বাড়ায়, সেই চাপ ঘনীভূত হয়ে আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়। এটা অনেকটা প্রবল ঝড়ের মতো। এ শব্দঝড়ে অনেক সময় কানের পর্দা ফাটে না, কিন্তু অন্তঃকর্ণের গুরুতর ক্ষতি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতির পরই শব্দদূষণ সাধারণ স্বাস্থ্যের পক্ষে অন্যতম ক্ষতিকারক। কিন্তু শব্দবাজির শব্দদূষণে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শব্দবাজির আওয়াজ ব্যঞ্জনধ্বনি শোনার অভিজ্ঞতাও পাল্টে দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তারা। শব্দবাজির কারণে উচ্চ তরঙ্গের (হাই-ফ্রিকোয়েন্সি) ধ্বনি শোনার ক্ষেত্রে বধিরতা তৈরি হয়। ফলে পুরো শ্রবণ-অভিজ্ঞতাই পাল্টে যেতে পারে।
অথচ শব্দদূষণ নিয়ে আলোচনা একেবারেই কম। কিন্তু এ দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য নীরব ঘাতক। উন্নয়নের গতির সঙ্গে সঙ্গে এ দূষণ বাড়ছে। মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই ফলাফল ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় কারণে বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হচ্ছে। অধিক ভোগ বিলাসিতার জন্য শব্দদূষণ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে শব্দদূষণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। আলো দূষণ উন্নত বিশ্বে বেশি। শব্দ প্রাণিকুলের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এর সীমা থাকা দরকার, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল (শব্দের নিম্নতম পরিমাপক) সাময়িকভাবে শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয় আর ১০০ ডেসিবেল শব্দ হলে চিরতরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ থাকে বা আছে। আল্লাহ মনে হয় আমাদের সহ্যক্ষমতা বেশিই দিয়েছেন! প্রতিনিয়ত ভেজাল খাদ্য খেয়ে সহ্যক্ষমতা মনে হয় বেড়েই গেছে। না হলে শব্দদূষণে আরো ক্ষয়ক্ষতির হার বেড়ে যেত। শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্রশব্দ কানের ভয়াবহ ক্ষতি করে। সম্পূর্ণ বধিরও করতে পারে। আমাদের যানবাহন ও শিল্পকারখানা থেকে ভয়াবহ শব্দদূষণ হয়। শব্দদূষণের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া রোগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা, বমি বমি ভাব ও মানসিক অস্বাভাবিবকতা হতে পারে। একটানা গাড়ির শব্দ বা উচ্চশব্দ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পুরো ঢাকা শহরটাই এখন ভয়াবহ শব্দদূষণের শিকার। রাজধানীর সব এলাকায় শব্দ সহ্যসীমার অনেক বেশি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণমাত্রার দ্বিগুণ বা তিন গুণ পর্যন্ত রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ লোকের শ্রবণশক্তি কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ পাস হয়। এ আইনে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ও ক্ষতিকরের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা আছে। এ আইনে বলা আছে, প্রতি ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কী কী করবে। এসব কর্তৃপক্ষের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকা শনাক্ত করতে হবে। যেমন নীরব এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা, আবাসিক এলাকা প্রভৃতি। নীরব এলাকায় থাকবে হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হবে। ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে সজাগ করার কথা বলা আছে। এসব থাকলে জনগণ কোথায় কী করতে হবে জানবে। কিন্তু এ আইন সম্পর্কে তেমন কোনো প্রচার নেই। এ আইন বাস্তবায়ন করলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আইনের প্রচার ও বাস্তবায়ন, সচেতনতা সৃষ্টি, হর্ন বাজানো থেকে বিরত, জেনারেটর ও যন্ত্রপাতির শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে বা রাখতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা আছে, যা কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। শিল্প এলাকায় কম শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব মাইকের ব্যবহার কম করতে হবে। এড়িয়ে চলতে পারলে খুব ভালো হবে। না হলে কম শব্দ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। জাপানিরা বা উন্নত দেশের লোকরা কথা কম বলেন। কাজ বেশি করেন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। আমরা ধীরে ধীরে এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি। সচেতনতাই কেবল পারে আমাদের দেশে শব্দদূষণ দূষণ কমাতে। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে আসব। ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই খারাপ হবে।
লেখক : কবি, ও কলামিস্ট
"