আহমদ আবদুল্লাহ

  ১২ নভেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

হারিয়ে যাওয়া সবুজের সমারোহ

বদলে যাচ্ছে প্রিয় শহর ঢাকা। ক্রমেই দিনের পর দিন এ নগরীর যেমন আয়তন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে জনসংখ্যা। ক্রমবর্ধমান এ মহানগরীতে অজস্র যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্যপদার্থ ও কালো ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশকে দূষিত করছে। ঢাকা মহানগরীর সংখ্যা বর্তমানে এক কোটিরও বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরীতে গাছপালার সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় সবুজের চিহ্ন নেই বললেই চলে। এখন ঢাকা আবর্জনা আর বিষাক্ত বায়ুর শহর। এ শহরের পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ : ১. আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কারখানা স্থাপন। ২. অবাধে গাছপালা নিধন। ৩. ত্রুটিপূর্ণ পেট্রল ও ডিজেলচালিত যানবাহন এবং ৪. জলাবদ্ধতা। প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পরিবেশকে দূষিত করবে না।’ পুকুরের পানি, নদীর পানি, আবদ্ধ জলাশয়ের পানি যেন দূষিত না হয়, সে জন্য প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘আবদ্ধ পানি ও জলাশয়ের পানিতে তোমরা প্রস্রাব করবে না। প্রস্রাব করে তোমরা পানিকে দূষিত করে সেখানে আবার গোসল করবে না।’ (মুসলিম : ৪২৪)।

একসময় ঢাকা চমৎকার সবুজ গাছপালাবেষ্টিত এক সুন্দর শহর ছিল। সেসব গাছপালা এখন আর নেই। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে শহরের বাকি গাছগুলোও। মোগল আমল ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে শহরের নানা স্থানে মনমাতানো সব বাগান ছিল। সেসব এখন স্মৃতি হয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণের সঙ্গে। যেমন : লালবাগ, বাগে হোসেন উদ্দিন, বাগে বাদশাহী, বাগে মুসা, হাজারীবাগ, আমিনবাগ, নবাববাগিচা, মালিবাগ, সোবহানবাগ, গোলাপবাগ, গুপিবাগ, নবাব রশিদ খাঁ বাগিচা, বাগে মীর মোমেন, বলধা বাগান, শাহজাদা মিয়ার বাগিচা, কাজিরবাগ, শাহবাগ ইত্যাদি। সে সময় এ শহরে নানা রকম ফুল ও ফলের গাছ ছাড়াও যে গাছগুলো দেখা যেত, এর মধ্যে পান্থপাদপ, দেবদারু, কুরচি, নীলমণি, সিলভারওক, গুলমোহর, শিরিন, মেহগনি, দেবকাঞ্চন, পলাশ, সেগুন, তেঁতুল, কড়ই, পাইন, ছাতিম, বাবলা, রক্তকরবী এবং কৃষ্ণচূড়াসহ আরো বিভিন্নরকম গাছগাছালি। এই বৃক্ষরাজি শহরের যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে, তদ্রƒপ জনগণকে দিয়েছে মুক্ত বাতাস।

পরিব্রাজক বিশপ হেবার ঢাকার রাস্তায় পিপুল গাছের সমারোহ দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন। বাগান ধ্বংস করে এখন শহরে গড়ে তোলা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে হাইরাইজ বিল্ডিং আর বিশাল মার্কেট। একসময় এ শহর কৃষ্ণচূড়ার শহর বলেও খ্যাতি অর্জন করেছিল। ঢাকার রাস্তা আলোকিত করে রাখত এই কৃষ্ণচূড়া। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ড, ডিভাইডার ও ফুটপাতের পাশে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। এসব গাছ রোপণের পরই পরিচর্যার অভাবে মারা যায়। কোনো সময় একটু বৃষ্টির পানি পেয়ে বড় হয়ে উঠলেও অযতেœ তা নিঃশেষ হয়ে যায়। পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্যশস্য ও মৌসুমি ফলমূল উৎপাদনের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে, বৃক্ষরোপণ এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় কাজ। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যম-িত করেছেন। গাছপালা দ্বারা ভূম-ল ও পরিবেশ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে তাই ঘোষণা এসেছেÑ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়।’ (সুরা কাফ : ৭-৯)।

রাজধানী ঢাকার অন্যতম আকর্ষণ বুড়িগঙ্গা নদী। অন্যান্য শহর এ ধরনের সম্পদ পেলে খুব যতেœর সঙ্গে সংরক্ষণ করে। লন্ডনের টেমস বা প্যারিসের সেইম নদী যার প্রমাণ। বিশ্বের আধুনিক সব শহরে নিসর্গায়ন বা ল্যান্ডক্সেপিংয়ের দিকে জোর দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগরী অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠেছে, ঢাকায় বনায়ন সম্প্রসারণের বিষয়টি নগর পরিকল্পনাবিদদের কাছে উপেক্ষিত রয়ে আছে। নদীবেষ্টিত রাজধানী নগরী ভেনিস হওয়ার কথা থাকলেও সে নগরী এখন বাসোযোগ্য নগরী হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রকাশিত তালিকায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৪০টি দেশের ওপর করা জরিপে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা শহরের অবস্থান ১৩৯তম। বাসযোগ্য শহরের তালিকায় সবার ওপরে ভিয়েনা। ওয়ার্ল্ড পুপুলেশন রিভিউয়ের ভাষ্য মতে, ভিয়েনা শহরের প্রতি বর্গকিলোমিটারে চার হাজার মানুষ বাস করে। আর ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার মানুষ বাস করে। বাসযোগ্য না হওয়ার এটা একটি বড় কারণ। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা যদি আন্তরিকভাবে করা হতো, তাহলে বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকার স্থান দ্বিতীয় হতো না। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পরই ঢাকার স্থান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রাজধানীবাসীর নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুভাগ করেছিলেন। কিন্তু নাগরিক সুবিধা ন্যূনতম বৃদ্ধি পায়নি। বরং দিন দিন ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। যানজট, ধুলাবালি, ধোঁয়া, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও মশার যন্ত্রণায় নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও পরিত্রাণের উপায় নেই। ঢাকায় পথচারীদের চলাচলের জন্য যতটুকু সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, সেটুকুও নেই। যতটুকু আছে, সেখানেও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে হাট-বাজার, দোকানপাট গড়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন।

মোগল আমলে এবং উনিশ শতকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর পর্যটক এলাকা হিসেবে খ্যাত ছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই নদীর তীর চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তোলা হয়েছিল পার্ক ও বাকল্যান্ড বাঁধ। বিশ্বের অনেক আধুনিক নগরীতে রয়েছে সবুজের বেষ্টনী, উদ্যান পার্ক এবং সৌন্দর্যম-িত নদীর তীর। বুড়িগঙ্গা নদীর পরিবেশও একসময় দেশি-বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে। বর্তমান এখানে কলকারখানা ও নানা রকমের আবর্জনা ফেলার কারণে নদীর পানি ও তীর দুটোই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের পার্কগুলো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অংশ। এখানকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি এগুলোর সৌন্দর্য রক্ষায় আরো নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। বারবনিতা আর নেশাখোরদের দৌরাত্ম্য থেকে ঢাকার পার্কগুলো রক্ষা করতে হবে। এর জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সুন্দর পরিবেশ গড়ার প্রয়োজনে যুগোপযোগী আইন তৈরি করে তা প্রয়োগ করতে হবে। রাজধানীর ফাঁকা জায়গায় বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি ছাদের বাগান বা রুফগার্ডেন সম্পর্কে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। সবুজ গাছপালা এ নগরীর শব্দ ও বায়ু দূষণ রোধ করে। এ ছাড়া তাপমাত্রা শীতল রাখতে সাহায্য করে। ঢাকা শহরের অনেক বাড়ির ছাদে ইদানীং ফুল, ফল ও সবজি বাগান করে অনেকেই বিভিন্নভাবে উপক্রম হচ্ছেন। এটা পরিবেশের জন্যও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ঢাকা শহরের নতুন-পুরনো এলাকার খেলার মাঠ, অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ফাঁকা জায়াগায় বৃক্ষরোপণ করতে হবে। এসব জায়গায় যদি গাছপালা আগে থাকে, তাহলে তা কাটতে দেওয়া যাবে না। রাজপথের পাশে ফুলের চারা রোপণ করা যেতে পারে। এতে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এলেই বিভিন্ন সংস্থার বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অযতœ, অবহেলা আর পরিচর্যার অভাবে মারা যায়। তাই আমাদের সবার দৃষ্টি এদিকে মনোনিবেশ করতে হবে। লাগানো গাছের সুষ্ঠু পরিচর্যা ও একে বাঁচানোর মাধ্যমেই আমরা সুন্দর ও বসবাসযোগ্য নয়ন জুড়ানো একটি শহর পেতে পারি। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকায় রোপিত বৃক্ষগুলো ঢাকাবাসীর সহযোগিতা ও পরিচর্যায় বেড়ে উঠবে এবং শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশী।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close