এস এম মুকুল

  ১০ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

টাকা যখন কালো হয়

কালোটাকা অর্থনীতিতে একটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত এমনকি বিতর্কিত বিষয়। সেই কালোটাকার ভালো-মন্দের কাহিনি নিয়েই এ লেখার প্রয়াস। তবে তার আগে টাকাবিষয়ক কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। যতদূর জানা যায়, সংস্কৃত টংক শব্দ থেকে এসেছে ‘টাকা’ শব্দটি। যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার বিনিময়মাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্রীয় মুদ্রার নাম নির্ধারণ করা হয় ‘টাকা’। টাকার বাংলা সাংকেতিক চিহ্ন ‘$’। ইংরেজিতে আন্তর্জাতিকভাবে এই টাকার সাংকেতিক পরিচয় ‘বিডিটি’তে বোঝানো হয়। এবার জেনে রাখুন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কাগুজের নোটটি হচ্ছে বাংলাদেশের দুই টাকার নোট। রাশিয়ার বিনোদনবিষয়ক অনলাইন ভোটের মাধ্যমে বিশ্বের সুন্দরতম নোট হিসেবে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশের দুই টাকার কাগুজে নোট।

এবার কালোটাকা প্রসঙ্গ। টাকার আবার কালো কী? টাকার পৃথক কোনো রং-রূপ নেই। রূপে-রঙে কালো বা সাদা টাকার অস্তিত্ব নেই। কারণ শব্দ দুটি অলীক। এমন টাকার অস্তিত্ব না থাকলেও আছে কালোটাকার ‘কালো কাহিনি’। সম্ভবত এ কারণেই আছে সাদাটাকার কথাও। তাহলে কালোটাকা কী? কালোটাকার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও আমরা সহজ অর্থে বুঝি অনৈতিক উপায়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ‘কালোটাকা’ নামে পরিচিত। কালোটাকা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে একটি অপ্রদর্শিত-অপ্রকাশ্য রূপ। তাহলে কোন টাকা কালোটাকা? অবৈধভাবে অর্জিত টাকা যেমন : দুর্নীতি, ঘুষ, কালোবাজারি, চোরাকারবারি, মাদক বা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্জিত আয় কালোটাকা নামে অভিহিত।

কী কী উপায়ে টাকা কালো হয়? সম্পত্তি দখল, খেলাপি ঋণ, সরকারি কোষাগারের অর্থলুট, সরকারি কাজে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ লোপাট, ঘুষ, দুর্নীতি, কর অবকাশের নামে সরকারি সুবিধা নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, চোরাচালান-চোরাকারবার, সরকারি ক্রয়, সরকারের বিভিন্ন দফতরের সংস্কার, নাম পরিবর্তন, পোশাক পরিবর্তনের নামে লোপাট, আন্তর্জাতিক টেন্ডার চুক্তি, মুদ্রা পাচার বা হুন্ডি ব্যবসা প্রভৃতি নানান নামধারী উপায়ে উপার্জিত অর্থ গোপন লেনদেন বা গোপনে ব্যবহারের মাধ্যমে কালোটাকায় পরিণত হয়।

বাজেট এলেই আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয় কালোটাকা। অথচ কালোটাকার বলয়ে আবর্তিত আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি, আমলা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে কালোটাকার সাদা বেশধারী মানুষের সংখ্যা অনেক। এই বলয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কালোটাকা। কালোটাকা সাদা করার যত বিরোধিতা হচ্ছে ততই বাড়ছে কালোটাকার উৎপাদন কৌশল। সমাজ এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করছে এই কালোটাকা। কথা হলো, এই কালোটাকার উৎস কি নির্মূল বা বন্ধ করা সম্ভব? উত্তর হবে না? রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে কালোটাকার উৎসগুলো বন্ধ হবে না। সুতরাং কালোটাকা থাকবেই। আমরা দেখেছি এক-এগারোর কেয়ারটেকার সরকারের আমলে কালোটাকার মালিকদের তালিকা ছাপা হয়েছে। এই তালিকায় নাম এসেছে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে অফিসের পিয়ন এমনকি দালাল পর্যন্ত। বাশিলের ভেতর টাকা, চালের ড্রামে টাকা, বস্তায় টাকা, গাড়িতে টাকা। টাকার এমন সস্তা খবর কতই না দেখা হলো। ওসমান গণি থেকে শুরু করে অফিস পিওনের বাগানবাড়ি, হরিণ বিহার, অট্টালিকা, গাড়ি বিলাস কত কাহিনি জানা গেল। কী হয়েছে তাদের? তাদের সম্পদ কি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। টাকা কি সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে? হয়ে থাকলে কত টাকা জমা হয়েছে আর এখান থেকে কত কালোটাকা ভালো করার নামে দুর্নীতি আশ্রয়ে আবার কালোটাকার কাহিনি তৈরি হয়েছে, সে খবর কে দেবে?

করফাঁকি, সুদ, ঘুষ আর দুর্নীতির সংস্কৃতি বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই কমবেশি বিদ্যমান। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে ভারতের ১৯৮৩ ও ৮৪ সালে ব্ল্যাকরুপি পরিমাণ ছিল তাদের দেশজ মোট উৎপাদনের ১৯ ও ২১ ভাগ। সেখানে কালোটাকার মালিকরা ২৪ দশমিক ৫ লাখ কোটি ব্ল্যাকরুপি বিদেশে পাচার করেছে। বলা হয়েছে, এই ব্ল্যাকরুপির অর্ধেক পরিমাণও যদি স্বাভাবিক অর্থনীতিতে যুক্ত হতো, তাহলে ভারত সরকার বছরে দুই হাজার বিলিয়ন রুপি অতিরিক্ত রাজস্ব পেত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো ৭০ কোটি কালোটাকা সাদা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে দুই দফায় ১৯৮৮-৮৯ সালে ২০০ কোটি এবং ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ২৫০ কোটি কালোটাকা সাদা করা হয়। পরবর্তী বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং প্রশংসিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে প্রায় প্রতি বছরই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। ফলে সে সরকারের আমলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মতো কালোটাকা সাদা হয়। পরে চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালে বিনিয়োগ শর্তে ২০০১-০২ অর্থবছরে ৪০০ কোটি, ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১০০০ কোটি এবং ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪৬০৩ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। ২০০৭-৮ সালে এক-এগারোর কেয়ারটেকার সরকার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়, যার পরিমাণ ৯৬৭৭ কোটি টাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১৮ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা করার মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কর আকারে আদায় করেছে। যার পরিমাণ এই ৪২ বছরে বেড়ে বৈকি।

এই যদি হয় কালোটাকা সাদা করার কাহিনি, তাহলে প্রশ্নÑকালোটাকার পরিমাণ আসলে কত? এর সঠিক পরিসংখ্যান কী আছে? অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে অঘোষিত বা কালোটাকার পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ। যার পরিমাণ ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। আরেক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর ৭০ হাজার কোটি টাকার কালোটাকা অর্জিত হয়। যার থেকে ২০ হাজার কোটি কালোটাকা কোনো না কোনো উপায়ে সাদা নামে বৈধ হয়। অনেকের ধারণা সরল হিসাবে সর্বনি¤œ হার ধরলেও দেশে মোট কালোটাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।

এখন বিচার করে দেখার সময় এসেছে কালোটাকা সাদা করলে লাভ, নাকি কালোটাকার উৎস বন্ধ করলে ভালো। তবে এ কথা সত্য, কালোটাকার উৎস নির্মূল করা সম্ভব নয়। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলে খারাপ দিকগুলো কী? অনেকের মতে, এতে দুর্নীতিকে আরো উৎসাহিত হয়, নীতিবান ব্যবসায়ীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়, দুষ্টচক্র ও কালো অর্থনীতির লালন করা হয়, অর্থসংক্রান্ত দুর্নীতি সম্প্রসারিত হয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরেÑকালোটাকা সাদা করার সুযোগে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ হলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, অপরাধপ্রবণতা ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। অন্যপক্ষে কালোটাকার মালিক যদি বৈধ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ না পায়, তাহলে কালোটাকা কালো জগতে চক্রে ঘুরপাক খাবে। ফলে কালো অর্থনীতির বিস্তার ঘটবে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক অস্থিরতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পাবে। কালোটাকার মালিক কালো জগতে অর্থ ব্যয় না করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের ব্যাংকে স্বল্পসুদে নিরাপদে রাখার জন্য পাচার করবে। এর ফলে দেশের টাকা বিদেশ চলে যাবে। কালোটাকাকে হালাল ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে বিদেশিরা। যেমন : মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্প’। আমাদের দেশে কালোটাকার নিন্দিত মালিকরা মালয়েশিয়ায় বাড়ি-গাড়ি করে নন্দিত ধনাঢ্য ব্যক্তির মর্যাদায় আসীন হতে পারছেন। তাহলে কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ না দেওয়াটা ক্ষতিকর নয় কি? বাংলাদেশি পুঁজিপতিরা লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি এসব দেশের নাগরিক হয়েছেন। অসংখ্য বাংলাদেশি ব্যবসায়ী-শিল্পপতির বিনিয়োগ আছে বিদেশে। অতএব কালোটাকা আটকাবেন কী করে। আমাদের দেশ আটকাবে তো, অন্য দেশ তাদের আশ্রয় দেবে! তাহলে দেখা যাচ্ছে, কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ দেওয়াটাই উত্তম। এতে বিনিয়োগ সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। সরকার পাবে রাজস্ব। তবে রাজস্ব আদায় জোরদার হতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা কালোটাকা তৈরির উপায় বন্ধ, এসব ক্ষেত্রে নজরদারি ও আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। তবে কালোটাকা সাদা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং যেসব কারণে বা উপায়ে সাদাটাকা কালো হয়, সেসব কারণ বা উপায় চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে নতুন কোনো কালোটাকা উৎপাদিত না হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেÑ১. আকস্মিক ঘন ঘন অনুসন্ধানের মাধ্যমে কালোটাকা জব্দ করা, ২. কেনাবেচায় রেকর্ড সংরক্ষণ আবশ্যিক করা, ৩. গোঁজামিল বা করফাঁকি প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করা, ৪. সরেজমিনে জরিপ করে কর প্রদানে সক্ষম সবাইকে করের আওতায় আনা। ৫. দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ শক্তিশালী করা এবং একে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও সুপারিশ থেকে মুক্ত রাখা, ৬. মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারি আমলার বিরুদ্ধে তদন্ত বা অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করা।

অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কালোটাকার উৎস বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়াই হবে সর্বোত্তম উপায়। তবে কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকগুলোকে বেছ নেওয়া যেতে পারে। আমাদের সেতু, বিদ্যুৎ খাত, জেলা ও থানা পর্যায়ে শ্রমঘন শিল্প এসব খাতকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। আবাসন খাতের জন্য এ সুযোগ বড়লোকদের আরো বড় করার সুযোগ বলে অনেকের অভিমত। কারণ কালোটাকা সাদা করার জন্য তারা এখন বৈধভাবে অসংখ্য ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হয়ে যাবেন। ফলে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশে উঠবে। মধ্যবিত্তরা আর ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখতে পারবেন না। তাই সুযোগ প্রদানের বিষয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তার আবশ্যকতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতি আছেন। তারা সবাই কি ট্যাক্স দেয়? তাহলে বোঝা গেল টাকাওয়ালাদের ধরতে পারছে না সরকার। সুতরাং শুধু কালোটাকা সাদা করা নয়, সব টাকাওয়ালাদেরও ট্যাক্স ফাঁকি বন্ধ করা উচিত। ট্যাক্স আদায়ে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই সুফল পাওয়া যাবে।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close