ডা. এস এ মালেক

  ০৮ নভেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

অর্থবহ সংলাপ ও নির্বাচন

নির্বাচন তো হতেই হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে যথাসময়ে নির্বাচন হতে হবে। যারা সরকার পরিচালনা করছেন, এটা তাদের আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। একই কারণে কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হয়েছিল। তখন মূল বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে রাজপথে দেশব্যাপী যে সহিংসতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার পরিণতি তাদের আজও ভোগ করতে হচ্ছে। তাই মনে হয়, একইভাবে ও একই কারণে তারা এবার নির্বাচন বর্জন করবে না। পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক না কেন, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিতেই হবে। খালেদা জিয়া মুক্ত হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে আর মুক্ত না হলে নির্বাচনে যাবে না, এটা কোনো আইনসংগত রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। যেহেতু রাজনৈতিক কারণে খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হননি, তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো আর আদালতকে নির্দেশ দিতে পারেন না, সাজা প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দিন। এ পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে বিএনপি ও তার নেতাদের সরকারের সঙ্গে অবশ্যই সমঝোতা করতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সমঝোতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নেওয়া হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশেও এর নজির রয়েছে। আলোচনার আগে শর্তারোপ, আলোচনা ব্যর্থ হলে সশস্ত্র সংগ্রাম করার এরূপ হুমকির মুখে আর কেউ হন না কেন শেখ হাসিনাকে নতিস্বীকার করানো সম্ভব নয়। তা শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের অনেক দেশেও উপলব্ধি করতে পেরেছে। তবে এ কথাও ঠিক, শেখ হাসিনা যেমন কঠিন ও কঠোর, অন্যদিকে একইভাবে বিনয়াবনত। এ পর্যন্ত বাস্তব যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে নির্বাচন, সবার অংশগ্রহণে না হলেও অধিকাংশের অংশগ্রহণে যে অনুষ্ঠিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়া যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। ফলে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তবে এ কথাও ঠিক, বিএনপি একটা বড় দল। তার সমর্থকও রয়েছে প্রচুর। তাই দলটি নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে নির্বাচনের কিছুটা অঙ্গহানি তো হবেই। সরকারি দল থেকে বলা হয়ে আসছিল, নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপের প্রয়োজন নেই। এ বক্তব্য রাজনৈতিকসুলভ ছিল কি না, তা নিয়ে কারো কারো মনে প্রশ্ন উঠেছিল। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বাস্তবতার নিরীক্ষেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মনে হয় সরকারি দল থেকে সংলাপ না করার যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, তা ছিল একেবারেই কৌশলগত। সংলাপ করা হবে না এরূপ বক্তব্যের বিপরীতেই বিএনপি সংলাপ করার পক্ষে বারবার জোর দাবি জানিয়ে আসছিল। শেখ হাসিনা একজন সুকৌশলী রাজনীতিবিদ। তার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এ পর্যন্ত তার বিরোধীরা কোথাও যুক্তিতর্কে পেরে ওঠেনি। হঠাৎ করে সংলাপে রাজি হওয়ার যে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন, তার প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বেশ কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। বিগত কয়েক দিন হলো সংলাপ শুরু হয়েছে। এতে সরাসরি বিএনপির নেতৃত্ব বলতে যা বোঝায়, তারা সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও বিরোধী দল থেকে ওই সংলাপে যিনি মূল ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। তিনি এমন মাপের নেতা যিনি সব সময় বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বুকে ধারণ করেন। তিনি যখনই ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে এলেন, তখনই আওয়ামী লীগ সংলাপে বসার জন্য সাড়া দিয়েছে। এমনকি সাংবিধানিক ধারায় যুক্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছাতেও রাজি আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি তাদের আগের অবস্থানেই থাকবে? না ঐক্য প্রক্রিয়ার ফ্রন্টের গঠনের পর নতুন আঙ্গিকে যুক্ত হয়ে সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছুটা নতিস্বীকার করে হলেও তিনি সংলাপ না করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। তিনি বিরোধী দলকে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টির সুযোগ দিতে চান না। এ কথা ঠিক, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে রাজপথে সংগ্রাম করে আর নির্বাচনে গিয়েও সশস্ত্র সন্ত্রাস করলে উভয় ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের প্রকৃতি একই রকম হবে না। প্রধানমন্ত্রী চান দেশের চলমান উন্নয়নধারা যেন কোনো প্রকারে ব্যাহত না হয়। বিরোধী দল রাজপথে প্রতিবাদী আন্দোলন করছে এবং আগামীতেও করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে। তবে সে আন্দোলন যেন সম্পদবিধ্বংসী না হয়। উন্নয়নের গতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করতে স্বীকৃতি জানান। এ কথা সত্য, ঐক্য প্রক্রিয়া গঠনের পর দলকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কারণ বিএনপি তো ছিলই, বিএনপির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপি জোগ দেওয়ায় ও এমন কিছু ব্যক্তি ঐক্য প্রক্রিয়ার ফ্রন্টের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে, যারা মূলত সহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সঙ্গে সংহতিতেও বিশ্বাসী নন। তাই তাদের সঙ্গে বসতে কোনো আপত্তি নেই। ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দিলেও জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সব সময়ের জন্য মেনে নিয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও তিনি ভালো করেই জানতেন এ ব্যাপারে বিএনপির অভিমত কী? এবং সেই অভিমতকে অগ্রাহ্য করে তিনি সমঝোতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতেও একাধিকবার জাতির জনক উল্লেখ রয়েছে। বিএনপি যে জোটভুক্ত হয়েছে, সেই জোটের প্রধান দফতর ড. কামাল হোসেনের এই অভিমতে বিএনপির সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি। বরং এরূপ একটা ব্যাপারে তাদের সহনশীল হতে হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি এরূপ সহনশীলতা সৃষ্টি করা যায় এবং ড. কামাল হোসেন সব সময়ই বলে আসছেন তিনি স্বাধীনতার শত্রু জামায়াতের সঙ্গে নয়। তা যদি ড. কামাল হোসেন একসময় বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং তাতে যদি আংশিক বিজয় বলে অভিহীত করা যায়, তবে সে বিজয়ের সার্থকতার অংশীদার তো আওয়ামী লীগই হবে। যে ভাষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ চলাকালীন সময়ে কথা বলেছেন, তা সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদলের প্রায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। বিএনপি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও প্রথবার সংলাপের পর দ্বিতীয়বার সংলাপে বসতে রাজি হয়েছে। সংলাপ সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে, তাতে সফলতা নিশ্চিত বা অনিশ্চিত এরূপ বলা এখনো ঠিক হবে না। মূল বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপি যদি দেশ ও জাতির স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড সংলাপে অংশগ্রহণ করে, তাহলে সমাধান হতেও পারে। অবশ্য সংকটের সমাধান না হলে বিএনপি যে পথে চলার দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তা কারো জন্যই সুখকর হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সরকারকে কঠোর হস্তে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সরকার অগ্রাহ্য করবে। কারো পক্ষে যতই সহিংস তৎপরতা দেখানো হক না কেন, দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকারকে তা দমন করে নির্বাচন দিতে হবে। এ ব্যাপারে মূল বিরোধী দল বিএনপির কাছ থেকে জনগণ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি রাখে। হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, সম্পদ ধ্বংসের রাজনীতি জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না। এ অভিজ্ঞতা বাংলার জনগণকে এতই সচেতন করেছে, আগের মতো ঘটনা ঘটার চেষ্টা করলে জনগণই তা প্রতিহত করবে। আর সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় ফিরে এলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পথ সহজ হবে। বিএনপি নেতৃত্ব বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান যে নজির স্থাপন করেছেন, তাই ওই দলটি জনগণের দুর্যোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বিএনপি থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে অপপ্রয়াস দলের একটা অংশ অব্যাহত রেখেছে, তা কখনোই সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যেই আদালত কর্তৃক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মনে হয়, দলের বৃহত্তর অংশ এই উপলব্ধিতে পৌঁছে গেছে, খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান দলটিতে যে ধরনের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন, তাই দলটির বর্তমান দুর্যোগের ঘনঘটার মূল কারণ। সময় ও সুযোগ এসেছে এই দুই নেতৃত্বকে দলের বাইরে রেখে দল পুনর্গঠন করা। একই সঙ্গে জামায়াতবিবর্জিত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের মাধ্যমে দলটির সংস্কার করা যায়, তাহলে স্বাধীনতার সপক্ষে বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সহ-অবস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির যে দাবি উঠেছে, সরকার হোক আর বিরোধী দলে হোক উভয় ক্ষেত্রে এ দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোর মধ্যে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তা হবে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির বিজয়।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close