জাহাঙ্গীর আলম জাবির

  ০৭ নভেম্বর, ২০১৮

ধর্ম

আখেরি চাহার সোম্বার

আরবি বর্ষপঞ্জিকার দ্বিতীয় মাস সফর। প্রাচীনকালে ‘সফর’ মাসকে ‘সফর-উল-আখিরা’ বলা হতো। ইসলামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এ মাসে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ বুধবার। ফার্সিতে এ দিবসটিকে ‘আখেরি চাহার সোম্বার’ বলা হয়। এদিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষবারের মতো শারীরিক সুস্থতাবোধ করেছিলেন। এ কারণে এ দিবসটি বিশেষ মর্যাদায় মুসলিম বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। সপ্তম হিজরিতে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধের নাম ‘খায়বরের যুদ্ধ’। জানা যায়, সে সময় খায়বরের ইহুদি নেতা সালাম বিন মাশকামের স্ত্রী ‘জয়নব’ প্রিয়নবী (সা.)-কে খাবারের সঙ্গে বিষমিশ্রিত করে তাঁকে হত্যার অপচেষ্টা করে। কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি বিষমিশ্রিত খাবার খেয়েও বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পান। ওই বিষমিশ্রিত খাবার খেয়ে বিশিষ্ট সাহাবি হজরত বশর ইবনে বারা (রা.) শহীদ হন। এ ঘটনার পর ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ সপ্তাহে নবী করিম (সা.) ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাথা মোবারকের যন্ত্রণা ও জ্বরের তাপমাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। সাহাবাসহ মদিনার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নেমে আসে এক অজানা শঙ্কা। সর্বত্র নেমে আসে বিষণœতার ছাপ। এর কয়েক দিন পর সফর মাসের শেষ বুধবার নূর নবী করীম (সা.) কিছুটা সুস্থতাবোধ করেন এবং তিনি তার প্রিয় সহধর্মিণী হজরত আয়েশা (রা.)-কে ডেকে গোসল করিয়ে দিতে বলেন। হজরত আয়েশা (রা.) নবীজিকে যতœসহকারে গোসল করিয়ে দিলেন। গোসলের পর রাসুল (সা.) দেহ মোবারক থেকে রোগজনিত দুর্বলতা সহসা দূরীভূত হয়ে গেল। এ খবর পেয়ে মদিনাবাসীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সুস্থ শরীরে তিনি মসজিদে গমন করেন এবং নামাজে ইমামতি করেন। নামাজ শেষে মিম্বারে দাঁড়িয়ে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহপাক তাঁর এক বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহপাকের কাছে যাহা আছে, এ দুয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার এখতিয়ার প্রদান করেছেন।’ সে বান্দা আল্লাহপাকের কাছে যা আছে, তা গ্রহণ করল। প্রিয়নবী (সা.)-এর এই কথা শুনে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বুঝতে পারলেন এ বক্তব্যের মর্ম, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লে তখন নবীজি (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-কে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, ‘হে আবু বকর! ধৈর্য ধারণ করুন। প্রকৃতপক্ষে আমার জন্য জান-মাল কোরবান করার ক্ষেত্রে আবু বকরই সবার চেয়ে উদার। আমার পক্ষে যদি সর্বাপেক্ষা বন্ধুরূপে কাউকে গ্রহণ করার সুযোগ থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আমি আবু বকরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম।’ প্রিয়নবী (সা.) ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ বুধবারের পর আবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আবারও নেমে আসে বিষাদের কালো ছায়া। পরদিন বৃহস্পতিবার নবীজি তিন তিনবার গোসল করে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে নববীতে যেতে চাইলেন এবং প্রতিবারই চেতনা হারিয়ে ফেলেন। অবশেষে চতুর্থবারের পর চেতনা ফিরে পেয়ে বলেন, ‘আবু বকরকে বল, লোকদের ইমামতি করে নামাজ আদায় করুক।’ তারপর সোমবার সকালে সুস্থতাবোধ করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নবীজি (সা.) বারবার চেতনা হারিয়ে ফেলেন। একবার বেহুঁশ হচ্ছেন আবার চেতনা ফিরে পাচ্ছেন। এই হৃদয়বিদারক অবস্থা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কাছে অসহনীয় হয়ে পড়লেন এবং বলে উঠলেন, ‘হায়রে আমার বাবার অস্থিরতা’। মেয়ের এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘আজকের পর তোমার বাবার জন্য আর কোনো অস্থিরতা নেই।’ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী করীম (সা.)-এর ওফাতের কিছুক্ষণ আগে তাঁর প্রিয় পতœী হজরত আয়েশা (রা.)-এর কোলে মাথা মোবারক রেখে রাসুল (সা.) এ নশ্বর পৃথিবী পরিত্যাগ করে অবিনশ্বর জান্নাতে গমন করেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ওফাতের পূর্ব মুহূর্তে নবী করীম (সা.) ঊর্ধ্বপানে তাকালেন এবং মৃদু সুরে বলছিলেন ‘আল্লাহুম্মা বিররাফিকিল আলা’, হে আল্লাহ! আমি সর্বোচ্চ বন্ধুকে পছন্দ করি। এ বলে সমগ্র মুসলিম জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তাঁর প্রভুর সঙ্গে মিলিত হলেন।

লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close