এস এম মুকুল

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

বৈচিত্র্যময় কৃষি পাহাড়ে

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জুম। জুম চাষ করে জীবনযাপন করেন, তাই তাদের জুমিয়া বলা হয়। যুগ যুগ ধরে আদি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় জ্বালানি তেল, লবণ আর সাবান ছাড়া জুমেরা ফসল দিয়েই জীবনযাপন চলে পাহাড়িদের।

এক দশক আগেও এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর ১০-১৫ বছর ওই পাহাড়ে আর কোনো চাষ হতো না। পাহাড়কে দেওয়া হতো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল গড়ে ওঠার সুযোগ, উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য মাটি পেত অনেক সময়। কিন্তু জুম চাষের জমি সংকুচিত হওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে জুমিয়ারা একই পাহাড়ে ঘন ঘন জুম চাষ করছেন। আবার অর্থকরী ফসল হিসেবে জুমে বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি হলুদ, আদা, মুখি কচুর আবাদ বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে কমছে জমির উর্বরতা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বিকাশ, বৃদ্ধি পাচ্ছে পাহাড়ের ভূমিক্ষয়, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রাণিজসম্পদ।

পাহাড় এখন জুমের পাকা ধানে ভরপুর। তাই এ পাকা ধান বাড়িতে তোলা নিয়ে ব্যস্ত জুমিয়ারা। জুম হলো পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসল ফলানো। সমতল ভূমিতে যেমন প্রতি বছর ফসল ফলানো যায়, জুমে কিন্তু একই পাহাড়ে প্রতি বছর ফসল ফলানো যায় না। একবার জুম চাষ করার পর ওই পাহাড়টি ৪-৫ বছর পতিত রাখার পর আবার একই পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা জুম চাষকে বলেন স্থানান্তরিত কৃষি এবং কেউ কেউ পর্যায়ক্রমিক চাষও বলে থাকেন। চাষ পদ্ধতি এক হলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে জুম চাষ আলাদা নামে পরিচিত। জুম চাষকে চাকমা ভাষায় জুম, মারমা ভাষায় ইয়াঁ, ত্রিপুরা ভাষায় হুগ, খিয়াং ভাষায় লাই, বম ভাষায় লাও বলা হয়। পাহাড় বাছাই থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত জুমচাষিরা কয়েকটি ধাপে এ কাজ সম্পন্ন করেন। এ ধাপগুলো হলো দুজ মারা, জুম ফাঙ গরানা, জঙ্গল কাটা, জুম পোড়ানা, আরা কাজানা, মোনঘর তৈরি, আনুনী কাটা, বী খের সুরো, বীজ বপন, দুজ মারা, মধ্যসুলো ও মেইড সুলো, পেগরাগানা, ধান কাটা ফাঙ ও নোভাত খাওয়া, অন্যান্য ফসল তোলা। জুমের ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নানাজাতের ধান, কুমড়া, অড়হড়, শিম, শসা, করলা, ঢেঁড়স, তিল, ভুট্টা, আদা, যব, তুলা, হলুদ, পাহাড়ি আলু, কচু ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে, পাহাড়িরা প্রকৃতির সন্তান। জুম চাষও সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। জুমিয়ারা চাষে কোনো লাঙল অথবা কোদাল ব্যবহার করে না। বীজ বপনের পর কোনো রকম রাসায়নিক সার, কীটনাশক অথবা আধুনিক কোনো সেচও ব্যবহার করা হয় না। আর তাই জুমে উৎপাদিত সবজি, ফলমূল হয় খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জুমের ফসল কাটার মৌসুম। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চাষ হচ্ছে জুম চাষ। জুমিয়ারা পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতির এই আদি জুম চাষ করে থাকে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম প্রস্তুত করার জন্য গাছপালা কাটা হয়। মার্চ-এপ্রিলের দিকে শুকনা গাছপালা আগুনে পুড়িয়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করা হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় ফসল তোলা। জুম্ম নারীরা ব্যস্ত জুমের পাকা ধান কাটতে।

পাহাড়ে জুমখেতে এখন পাকা ফসল তোলার ভর মৌসুম। এ মৌসুমে উপযুক্ত জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ইঁদুরের উৎপাত কমে যাওয়ায় ভালো ফলন হয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়াই জুমের সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। জুমিয়াদের ঘরে ঘরে জুমের সোনালি ফসল তোলার আনন্দ। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস এ জুম চাষ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগই জুম চাষনির্ভর। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮১৮ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম চাষই একমাত্র কৃষি চাষ পদ্ধতি ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেবে তিন পার্বত্য জেলা ৫ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার অশ্রেণিভুক্ত বনভূমির সিংহভাগেই জুম চাষ করা হয়। তিন জেলার কমবেশি ৪৩ হাজার পরিবার জুম চাষনির্ভর। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির প্রায় ২২ হাজার, রাঙামাটির প্রায় ১০ হাজার ও বান্দরবানে প্রায় ১৩ হাজার জুমিয়া পরিবার আছে। বাংলাদেশের একমাত্র তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ জুম চাষ করা হয়। বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে নবান্ন উৎসব। তিন জেলার প্রায় ২৫ হাজার ৪০০ হেক্টর পাহাড় ভূমিতে জুম চাষ হয়েছে এবার। ধুম পড়েছে মারফা, বেগুন, ধানি মরিচ, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সব শেষে তোলা হবে তুলা।

ক্রিক অর্থ হলো দুই অথবা তিন পাহাড়ের সঙ্গে বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে পাহাড়ের পতিত জমিতে ক্রিকের মাধ্যমে মাছ চাষসহ অন্যান্য চাষাবাদে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিয়ে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৫ উপজেলায় দুই পাহাড়ের মাঝে ক্রিকের (ঘোনায় মাছ চাষের জন্য বাঁধ) মাধ্যমে অর্থাৎ পাহাড়ি ঘোনায় মৎস্য চাষের এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ৯৫টি ক্রিক নির্মাণ করা হয়েছে। আরো তিন শতাধিক ক্রিক নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সব ক্রিক নির্মাণ শেষ হলে শিগগিরই পার্বত্য এলাকায় মাছ চাষের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সবাই। ক্রিক পদ্ধতির সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাছ চাষ করা। তা ছাড়া ক্রিকের পানি দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করা, খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। আর যে বাঁধটা দেওয়া হয়, তার সুবিধা নিয়ে শাকসবজি চাষ করা, বাঁধের ওপর যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করা। মৎস্য বিভাগ পাহাড়ের মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে। এ কাজের মাধ্যমে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুফলভোগীরা মাছ চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন, শাকসবজির চাষ করে অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এখন জুম চাষের পাশাপাশি নতুন ক্রিক পদ্ধতিতে চলছে পাহড়ের কৃষি। পার্বত্য এলাকার এই ক্রিকের প্রকল্প এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

জুম চাষে ফলন কম হওয়ায় পাহাড়িরা আম, আনারসসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষ করছেন। ফলে পার্বত্য এলাকায় বেড়েছে ফল উৎপাদন। পাহাড়ে বাড়ছে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ। স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় বান্দরবানে জুম চাষ ছেড়ে ড্রাগন ফল চাষে ঝুঁকছেন পাহাড়িরা। চিম্বুক পাহাড়ের বসন্তপাড়ায় বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেকে। বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে জানা যায়, বিদেশি ফল হলেও পাহাড়ের জলবায়ু এবং মাটি দুটিই ড্রাগন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাহাড়ে ড্রাগন ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং পানির সেচ কম লাগায় এ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন পাহাড়িরা। আম্রপালি জাতের বাগান স্থাপনে পাহাড়ি এলাকায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়া ও মাটিতে রসের অভাবের কারণে এ আমের মিষ্টতা বেশি, যা অন্য জেলায়ও যথেষ্ট সমাদৃত। বাগানি আমের ভালো দাম পাচ্ছে, আবাদে আরো উৎসাহিত হচ্ছে। এখানে সীমিত আকারে রাগুয়াই নামক আমের বারমিজ জাতটির সম্প্রসারণ হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর মাল্টা-কমলা, বাতাবি ও অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের আবাদ দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়িদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস কলা চাষ। আগে অনেকটা নিম্নমানের চাঁপাকলা কম যতেœ আবাদ করা হতো। এখন দৃশ্য অনেকটা পাল্টাচ্ছে। বাংলাকলা আবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ লোক নির্ভরশীল কলা চাষের ওপর। পাহাড়ি এলাকায় লম্বা জাতের বহু বছরজীবী এক জাতের পেঁপে চাষ প্রচলন আছে। মূলত বসতবাড়ি ও জুমের ফাঁকে সীমিত আকারে এ ফলের চাষ চলছে। জুম চাষ তাদের জীবিকার আদিম পেশা হলেও তা আবাদ হয়ে থাকে বছরে কেবল এক মৌসুমে। কিন্তু কলা চাষ করে ফলন পাওয়া যায় বছরজুড়ে সব মৌসুমে। পার্বত্য জেলার অনেক বাগানের আধাছায়া যুক্ত স্থানে লটকন চাষের প্রচুর সুযোগ আছে বিধায় ১৫-২০ ফুট দূরত্বে এ ফল বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাঙামাটি কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, আগে জুম চাষে প্রচুর ফলন পাওয়া গেলেও দিন দিন ফলন কমছে। এর ফলে পাহাড়িরা ফলের বাগান চাষে ঝুঁকছেন। একইসঙ্গে বেড়েছে আদা ও হলুদ চাষ। এতে কৃষক লাভবানও হচ্ছে।

লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close