রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৩ নভেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক

দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক বিপরীতধর্মী ও দ্বান্দ্বিক। সাধারণভাবে চারদিকে তাকালেই এর সত্যতা চোখে পড়ে। আমরা দেখতে পাই, যে মানুষরা দরিদ্র, তারা অধিকাংশই হয় নিরক্ষর, না হয় স্বল্পশিক্ষিত। শিক্ষা যত কম, দারিদ্র্য তত বেশি। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে আমরা স্বল্পশিক্ষিত কিছু ধনী লোককেও দেখতে পাব, যারা দরিদ্র নয়। কিন্তু তাদের এই প্রাচুর্যের পেছনেও কোনো না কোনো মানসিক শিক্ষা সক্রিয় ছিল। হাবাগোবা বা মানসিকভাবে দরিদ্র মানুষ উত্তরাধিকারী সূত্রে বা লটারির মাধ্যমে ধনী হতে পারে কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম নিয়ম নয়। আবার এসব ব্যতিক্রমী অশিক্ষিত ধনী সমাজের জন্য সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি বয়ে আনে। তাই শিক্ষা বলতে আমি এই প্রবন্ধে শুধু স্কুল-কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বোঝাচ্ছি না। বোঝাচ্ছি প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের বিদ্যাশিক্ষা। এর জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো আবশ্যকীয় শর্ত নয়, যথেষ্ট শর্তও নয়। একজন মুখস্থ করে এমএ পাস করলেন, কিন্তু ওই বিদ্যা কাজে লাগাতে তিনি অক্ষম, তাহলে তার শিক্ষা বৃথা গেল। তিনি শিক্ষিত বেকার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়েই থাকবেন। আরেকজন বিদ্যালয়ে কোনো দিন গেলেন না কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার পাঠ নিয়ে সফলতার সঙ্গে সমাজে অবদান রাখছেন, তাকে আমি অশিক্ষিত বলব কি? সুতরাং আনুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বা ছাড়া দুভাবেই মানুষ ‘শিক্ষিত’ হতে পারে, সমাজে অবদান রাখতে পারে। সাধারণভাবে এই প্রবন্ধে দাবি করা হচ্ছে, আর্থিক দারিদ্র্য ও মানসিক দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা কোনো না কোনো ধরনের প্রকৃত ফলপ্রসূ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

শিক্ষা ও দারিদ্র্যের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র জনগোষ্ঠী কি অশিক্ষিতই থাকবে? দারিদ্র্য দূর করার জন্য চাই শিক্ষা। এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আর্থিক ও মানসিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য আনুষ্ঠানিক বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকৃত ফলপ্রসূ সম্মিলন প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা-পরবর্তী স্তরে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার প্রচলন ও সমন্বয় সম্ভব হলে দেশকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব। বিশ্বায়ন এই ক্ষেত্রে বিশাল সুবিধা হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও, নানা কাঠামোগত বাধার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে উপযুক্ত কাজ এবং উপযুক্ত শ্রমিক একে অপরের নাগাল না পাওয়ায় তৈরি হচ্ছে এক ধরনের প্যারাডক্স বা কূটাভ্যাসের। এ সমস্যা সমাধানের পথগুলো এই প্রবন্ধে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, দেশীয় ধনিকদের হাতে প্রচুর সম্পদ থাকলেও তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে মানবোন্নয়নে জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। যেখান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা খাতে বর্ধিত বিনিয়োগ দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে সুফল বয়ে আনতে পারে। আধুনিক বিশ্বায়নের ফলে মানুষের অবাধ গতি বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে পুঁজি ও পণ্যের পাশাপাশি শ্রমেরও আদান-প্রদান বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা যদি আরো অবাধ হতো, সত্য সত্যই যদি আমরা একটি ভিসামুক্ত পৃথিবী পেতাম, তাহলে জনসংখ্যা কোথাও কোনো সমস্যা হিসেবে বিরাজ করত না।

জনাকীর্ণ দেশ থেকে জনহীন দেশে সহজেই বহির্গমন সম্ভব হতো। পুঁজিঘন দেশ থেকে শ্রমঘন দেশে পুঁজি যেমন অবাধে চলে আসছে, তেমনি শ্রমঘন দেশ থেকে শ্রমও অবাধে পুঁজিঘন দেশে চলে যেত। ফলে উভয়েরই লাভ হতো অব্যবহৃত পুঁজি ও অলস শ্রম উভয়ই ফলপ্রসূভাবে ব্যবহারের সুযোগ মিলত। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। বিশ্বায়নের ফলে এই স্বতঃস্ফূর্ত সমাধানের পথে অনেকগুলো কাঠামোগত বাধা বর্তমানে গড়ে উঠছে। যেমন : জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রম-পণ্য-পুঁজির গতিবিধির অবাধ নিয়মগুলো সুষম নয়। পুঁজি ও পণ্য যত অবাধে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আসতে পারে, শ্রম তত অবাধে উন্নত দেশগুলোয় প্রবেশ করতে পারে না। প্রযুক্তি, পুঁজি ও জ্ঞানের অসম বিকাশের কারণে সব পুঁজি বা সব মানুষ সব জায়গায় সমানভাবে খাপ খাওয়াতেও পারে না। যেমন অতীতে অটোমেটিক তাঁত ভারতবর্ষে যখন ইংল্যান্ড থেকে রফতানি শুরু করেছিল বা অটোমেটিক তাঁতটাই ভারতে আমদানি হয়েছিল, তখন অসংখ্য ভারতীয় তাঁতি প্রতিযোগিতায় হেরে যান ও মৃত্যুবরণ করেন। মার্ক্সের ভাষায়, ‘ভারতীয় তাঁতির হাড়গোড়ের ওপর ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ আবার বর্তমানে উল্টোদিক থেকে আমাদের অশিক্ষিত লোকরা যখন ইংল্যান্ড যাচ্ছেন, তখনো সেখানে সবচেয়ে নিচু কাজগুলোই তাদের ভাগ্যে জুটছে! তাই অসম সম্পর্কের ফাঁদের কারণে বিশ্বায়নের প্রকৃত সুফল সুষমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। তাহলে আমাদের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়ার উপায় কী? এ কথা সত্য যে, আপেক্ষিকভাবে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা যত দিন বেকার থাকবে, তত দিন তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি অসম্ভব। সুতরাং, তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ সৃষ্টিই দারিদ্র্য থেকে মুক্তির প্রাথমিক পূর্বশর্ত।

আমরা সবাই জানি শ্রম সরবরাহ ও শ্রম চাহিদার মিলন ছাড়া কর্মনিয়োজন সম্ভব নয় আর এই মিলনের বিষয়টা শুধু পরিমাণের দিক থেকে সমান হলে হবে না। গুণের দিক থেকেও হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই শ্রমের গুণগত দিক ও শিক্ষাটাও কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত হতে হবে। তা না হলে আমরা একটি অদ্ভুত প্যারাডক্স বা কূটাভ্যাসের সম্মুখীন হব। বিশেষ করে অপরিকল্পিত বাজার অর্থনীতিতে এটি প্রায়ই ঘটে থাকে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুভাবে এই উল্লিখিত কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত ‘কূটাভ্যাসের’ বাস্তব মীমাংসা সম্ভব। একটি হচ্ছে কর্মনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা কমিয়ে যদি কিছু টাকা শিক্ষার জন্য ব্যবহার করেন। তার কাছে চাকরিপ্রার্থী বা চাকরিরতদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে শ্রমিকদের প্রয়োজনমতো ফলপ্রসূ শিক্ষা দিয়ে এ সমস্যা থেকে তিনি নিজ উদ্যোগেই মুক্ত হতে পারেন। তবে এখানে যৌথ স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থের একটি দ্বন্দ্ব থেকে যাবে। ধরা যাক কোনো ধনাঢ্য পুঁজিপতি আগ্রহী হয়ে একটি পোশাকশিল্পের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি করলেন। কিন্তু ব্যাপারটি এ রকম হতে পারে, তার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পাস করা ছাত্রকে অন্য কোনো মালিক বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিতে পারেন। এই সমস্যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলে বাহ্যিক সাশ্রয়। অর্থাৎ কাজ করলাম আমি কিন্তু ফল পাচ্ছে অন্যজন। ফলে এ অবস্থায় কাজটি কেউই করতে আগ্রহী হচ্ছে না। এ সমস্যা পরস্পরবিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তানির্ভর বাজার অর্থনীতিতে অনিবার্য। শিক্ষা যেহেতু একটি সর্বজনভোগ্য দ্রব্য, সে জন্য তার সরবরাহের দায়িত্বও বর্তায় ‘সার্বজনীন কর্তৃত্বের’ কাঁধে অর্থাৎ সরকার বা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হচ্ছে অর্থনীতির প্রয়োজনমতো একটি ফলপ্রসূ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে সবার জন্য শিক্ষা ও সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করা ও দারিদ্র্য দূর করা।

সুতরাং শিক্ষাকে যদি সত্যিই দারিদ্র্যদূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চাই, তাহলে আমাদের একই সঙ্গে শিক্ষার পরিমাণগত মাত্রা, শিক্ষার বিশেষ ধরন এবং শিক্ষার গুণগত মানÑএই তিনটি দিকেরই ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন অর্জন করতে হবে। প্রথমত, কয়েকটি মৌলিক শিক্ষাকে আপামর জনগণের নাগালের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ পড়তে পারা, লিখতে পারা ও গুনতে পারাÑএই ক্ষমতাগুলোকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এই সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান এমন হতে হবে, যাতে যেটাকে বলা হয় মৌলিক দক্ষতা, সেটা অল্প বয়সেই নাগরিকরা প্রত্যেকেই অর্জনে সক্ষম হন। তারপর যে পরবর্তী ধাপের শিক্ষা হবে সে শিক্ষার ধরনটি হবে কর্মমুখী এবং অর্থনীতির ও সমাজের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তার মানটিও হতে হবে বিশ্বমানের বা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড। তাহলে দেশ-বিদেশে যুগপৎ কর্মসংস্থানে কোনো বাধা থাকবে না এবং আমরা সামগ্রিকভাবে একটি ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উপহার পাব, শিক্ষিত হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার দুঃসহ অভিশাপ থেকে রক্ষা পাব এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সক্ষম একটি জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হব। মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ও দারিদ্র্যদূরীকরণের যে স্ট্র্যাটেজির কথা এখন অহরহ আমরা শুনতে পাই, তা এই যৌক্তিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এখন মনে করেন, বাংলাদেশে সঞ্চিত ধনের উৎপাদনশীল বিনিয়োগের অনুকূল বাস্তব পরিস্থিতি নেই। হয়তো সে জন্যই এ দেশের ধনী ব্যক্তিরা এবং উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক বিদেশি ধনী ব্যক্তিরাও এখানে সস্তা শ্রম পাওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগে ততটা আগ্রহী হচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় ভৌত কাঠামোর অভাব অর্থাৎ সাশ্রয়ী দামে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-বন্দর-যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদির অভাব।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। এ সম্পর্কে দুই ধরনের আপত্তির কথা শোনা যায়। প্রথমত, কেউ কেউ বলেন, সাত মণ তেলও পুড়বে না রাধাও নাচবে না। এমতাবস্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে তারা বলেন, অধুনা দুই প্রধান যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাক্রমে আসীন হচ্ছে, তাদের উন্নয়ন কৌশলে উৎপাদনশীল বুর্জোয়াদের তুলনায় লুটেরা বুর্জোয়াদের প্রাধান্যই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লুটেরা বুর্জোয়ারা প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছে বটে কিন্তু পূর্ব এশিয়ার বুর্জোয়াদের মতো তা উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করে দেশে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত করতে তাদের আগ্রহ কম। কিন্তু এই সুস্পষ্ট ও সরল বক্তব্যের সমস্যা হচ্ছে বক্তব্যটিকে আরেকটু গভীরে নিয়ে গিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন না করার সমস্যা। আসলে আমাদের যে মৌলিক প্রশ্নটি করতে হবে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঞ্চয় কেন উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না অথচ অন্যত্র কেন তা হয়েছিল? খুঁজে দেখতে হবে, এটা কি বাংলাদেশের বাঙালিদের চারিত্রিক ত্রুটি, নাকি বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধস্তন অবস্থানে থাকার জন্য দেশের ভেতরে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে, নাকি এটা বুর্জোয়া শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা, নাকি এটা রাষ্ট্রেরই এক সামগ্রিক ব্যর্থতা। আসলে এসব প্রশ্নই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে সমস্যার মূলে এবং তখনই হয়তো আমরা প্রকৃত সমাধানের চাবিকাঠিটি খুঁজে পাব।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close