আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ০১ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

ইলেকট্রনিক বর্জ্য

ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য (ঊষবপঃৎড়হরপ ধিংঃব ব-ঊ-ধিংঃব)। ত্রুটিপূর্ণ এবং অব্যবহার্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতিকে ই-বর্জ্য বলি। এগুলো মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন : ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, ক¤িপউটার, মোবাইল ফোন, ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে নিয়মনীতিহীন ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে মানবস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং পরিবেশ দূষণ হতে পারে। রসায়নবিদদের মতে ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ডিভাইসের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বর্জ্যও বাড়ছে। এই বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফাইল রাখলে ‘এসিডিক কন্ডিশন’ তৈরি হয়। পরে মাটির স্তর ভেদ করে পানির স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

ই-বর্জ্যতে থাকে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর পদার্থ। সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, পারদ, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), আর্সেনিক, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল (পিসিবি) ইত্যাদি অন্যতম। এই ক্ষতিকর পদার্থ মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশে গিয়ে মানুষের জন্য বিষাক্ত এক উপাদান সৃষ্টি করে। এগুলো আমরা দেখতে পায় না বলে এদের ভয়াবহতা স¤পর্কে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। কিন্তু এগুলো মরণঘাতি নীরব বিষ! যারা এগুলো সংগ্রহ করে, এগুলো নিয়ে কাজ করে, তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এগুলো। এগুলো পরিবেশের জন্য নীরব ঘাতক। একটি তথ্য দেই, একটি সেলফোনে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম ছয় হাজার লিটার পানি দূষণ করে। এতে ব্যবহৃত অগ্নিপ্রতিরোধক উপাদান যেমন সিসা, বেরিলিয়াম ক্যানসার, যকৃত, স্নায়ুযন্ত্রের ক্ষতি করে। ডিসপ্লে ও বোর্ডে ব্যবহৃত পারদ বা মার্করি মস্তিষ্ক ও কিডনি নষ্ট করে। গবেষণায় দেখা যায়, এক কাপ চা-চামচ পারদে বিশ একর জমির পানি দূষিত করতে পারে! ভেবে দেখুন একবারÑ মনের অজান্তেই কত কিছু ঘটছে! সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে। আর বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকির হার। ক¤িপউটারের সিপিইউ বা কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রাংশটির মতো কিছু কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদির মতো ক্ষতিকর পদার্থ থাকা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশের ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত শ্রমিক সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি অনেক বেশি। এ সমস্ত বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন প্রক্রিয়াতে শ্রমিকরা ভারী ধাতুর সং¯পর্শে যেন না আসে, সে ব্যাপারে অত্যন্ত যতœবান হওয়া উচিত।

২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় ঞযব এষড়নধষ ঊ-ধিংঃব গড়হরঃড়ৎ ২০১৪ : ছঁধহঃরঃরবং, ঋষড়ংি ধহফ জবংড়ঁৎপবং শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি বছর ৪ কোটি টনেরও বেশি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সারা বিশ্বের ই-বর্জ্যরে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে। ভারত ই-বর্জ্য উৎপাদনে বিশ্বে ৫ম। ভারতে ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয় বছরে ২০ লাখ টন। ই-বর্জ্যে অনেক অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও অন্যান্য উপাদান আছে, যেগুলো পুনঃচক্রায়ন করা সম্ভব। লোহা, তামা, সোনা, রুপা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম থাকে ই-বর্জ্য।ে প্রতি বছর বিশ্বে ই-বর্জ্য বৃদ্ধি পায় প্রায় ১০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে এই বর্জ্যরে শতকরা ৫ ভাগের বেশি পুনরুদ্ধার করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া যথাযথ না হলে ই-বর্জ্য থেকে তৈরি হওয়া নতুন সামগ্রী পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।

সেমিনারে ইউনাইটেড নেশনস ইউনিভার্সিটির স্টেপ ইনিশিয়েটিভের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২০১২ সালে বিশ্বে ৪৫.৬ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৬ সালে যা হয় ৯৩.৫ মিলিয়ন টন। বিশ্বে এখন ৩৫৬ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার হচ্ছে, ২০১৮ সালে বিশ্বে ৪০০ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে। বিটিআরসির তথ্য মতে বাংলাদেশে ১১.৬৫ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার হচ্ছে, যার ওজন ১ হাজার ১২৫ টন। ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল সেট ব্যবহৃত হচ্ছে। যার প্রতি বছর শতকরা ৩০ ভাগ ই-বর্জ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে।

সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের ব্যবহার বেড়েই যাচ্ছে। আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। না হলে আমরা মারাত্মক পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ব। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ই-বর্জ্য উৎপাদকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পুরনো জিনিসপত্র রেখে দিয়ে আর্থিক সুবিধা বা পুনঃসরবরাহ করে এ সহযোগিতা তারা করতে পারে। ভাগাড় তৈরি করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। ভারত ও চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। সর্বোপরি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি)

লালমনিরহাট, চুয়াডাঙ্গা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close