রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০১ নভেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

মারাত্মক সংকটে বিশ্ব বাণিজ্যযুদ্ধ

আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাণিজ্যযুদ্ধ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর এ শুল্ক কার্যকর হয়েছে। এর জবাবে ৫৪৫টি মার্কিন পণ্যের ওপর সমহারে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে চীন। চীন বলছে, বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে, তার পরও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাদের ব্যবসা নিয়ে যেতে পারেন। ইতোমধ্যে বিখ্যাত মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হার্লে ডেভিডসন বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চালু হওয়া পাল্টা শুল্কনীতির কারণে তাদের মুনাফা বছরে ১০ কোটি ডলার কমে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কিছু কারখানা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে ইইউ ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সংরক্ষণবাদ নীতি গ্রহণ করে এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে রীতিমতো বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অনেক নিরাপত্তাবিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, হয়তোবা এ বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বকে মারাত্মক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, এমনকি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

এভাবে একে একে ট্রাম্প-অনুসৃত অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বহির্বিশ্বে দুর্বল করে তুলছে এবং স্নায়ুযুদ্ধকালীন প্রতিবাদ রাশিয়াকে ক্রমে শক্তিশালী করে তুলছে। রাশিয়ার সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিদ্রোহীদের কাছ থেকে সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে। এমনকি ইসরায়েল অধিকৃত গোলান এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত সিরিয়ার ভূমিও এখন বাশার বাহিনীর করতলগত। ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় বাশার তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিদ্রোহীদের একে একে দমন করে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা ও রাশিয়ার শক্তিমদমত্ততার বাহিনী তৈরি করছে।

ট্রাম্পের দুর্বলতা ও পুতিনের শক্তিমদমত্তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত হেলসিংকি কনফারেন্সে পুতিনের কাছে তিনি রীতিমতো ধরাশায়ী হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ইস্যু নিয়ে তিনি পুতিনের সুরেই কথা বলেছেন। স্বায়ুযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার পুতিনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের পরাজয় হিসেবে এটা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়ার হেরে যাওয়ায় ইমপ্রেশনটি বিশ্বমিডিয়ায় স্থান করে নিয়েছে।

এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বৈশ্বিক ইস্যুগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের আবহমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান জড়িয়ে বুঝতে হবে। বিশ্বনেতৃত্বের জন্য যে ধরনের বৈশ্বিক উদারতা ও মহানুভবতা প্রয়োজন, সেই বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রকে ধারণ করতে হবে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘মনরো মতবাদ’ অনুসরণ করে বিশ্বরাজনীতি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃরাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে যেসব নীতি গ্রহণ করেছেন, সেগুলোর অধিকাংশ তাকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত ও দুর্বল করে রেখেছে। গত শতাব্দীর শেষ দশকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে কমিউনিজমের পতন এবং পুঁজিবাদের বিশ্বজয়ের যে তত্ত্বগুলো এ পর্যন্ত প্রচার করা হয়েছে, সেগুলোও এখন নতুন করে লেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে আশাবাদীরা এই ভেবে আশ্বস্ত যে, তিনি শরণার্থী, অভিবাসন, সীমান্ত নীতি ও আয়কর নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি শক্তিশালী করতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত অর্থব্যয় সংকোচন, বাণিজ্য অবরোধ; চীনসহ এশিয়া, ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য সংরক্ষণবাদ প্রভৃতি নীতির মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষুষ্ণ অর্থনীতিকে বেগবান করতে পারবেন বলে তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল পক্ষ বিশ্বাস করে আছে। বাস্তবতা হলো, ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সংহত করার প্রত্যয় শুধু ছুড়ে দেয়নি; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অঙ্গীকার ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে দেশটিকে বেঁধে রেখেছে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে। বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ, বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক বিষয়গুলোর সুরাহা করায় গন্ডিবদ্ধ দায়িত্ব পালন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সঙ্গে মানানসই নয়। সম্ভবত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাষ্ট্রনীতিক দূরদৃষ্টি ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্পৃহা ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। নিরাশাবাদীরা তাই দিন দিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হঠকারী, অদূরদর্শী ও স্বার্থান্ধ জাতীয়তাবাদী নীতি যুক্তরাষ্ট্রের বহিঃইমেজকে তিল তিল করে নষ্ট করে দেশটির বৈশ্বিক নেতৃত্বের যোগ্যতাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছে না; বিশ্বনেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন অনেকে।

অন্যদিকে নিরাশাবাদীরা রাশিয়ার উত্থান ও পুতিনের বৈশ্বিক নেতৃত্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মøান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকে অনেকে শ্রদ্ধা ও আশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু অচিরেই তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বশক্তির ইমেজে আপ্লুত থাকে। পুতিনের মতো সাহসী, শক্তিশালী, লৌহমানবরা তাদের দেশকে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর মৃত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে রাশিয়াকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত রাখার প্রচেষ্টা চালান। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা রাশিয়ার এ পুনরুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের তাৎপর্যকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন সব সময়। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৈশ্বিক নেতৃত্বের এ স্পর্শকাতর বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না, যা দেশটির বৈশ্বিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রীয় সমস্যা এখন মধ্যপ্রাচ্যে, যার কেন্দ্রে রয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বনেতারা যখন ‘দ্বিরাষ্ট্রিক’ সমাধানের প্রস্তাব গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে, তখন তা ভূলুণ্ঠিত করে নগ্নভাবে ইসরাইয়েলের দখলদারিত্বের পক্ষে থেকে, ফিলিস্তিনের নিধনযজ্ঞে ইসরায়েলকে উসকে দিয়ে এবং জেরুজালেমে ইসরায়েলের রাজধানী প্রতিষ্ঠার সহায়তা করে এবং সর্বোপরি জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর করে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাকে চিরস্থায়ী করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বরাজনীতিতে এক জটিল, অমীমাংসাযোগ্য অধ্যায় জিইয়ে রেখেছেন। ইরানের সঙ্গে পঞ্চশক্তি রাষ্ট্রগুলো পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরানের পারমাণবিকায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে ইরানের মতো অভিজাত আপসহীন ও সাহসী দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বনিরাপত্তার প্রতি একটি ঝুঁকি তৈরি করেছেন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার পর উত্তর কোরিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রায়নের পথ বন্ধ করে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ বারবার হাতছাড়া হচ্ছে ট্রাম্পের যথাযথ, ফলপ্রসূ উদ্যোগের অভাবে। ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থী ও অভিবাসীদের দেশ। ফ্রান্সের পূর্বসূরিরাও অভিবাসী। সেই বাস্তবতা ভুলে গিয়ে অভিবাসন নীতিতে তিনি এমন কঠোর সংরক্ষণবাদ অনুসরণ করেন, যা তাকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। মেক্সিকোর সঙ্গে দেয়াল নির্মাণ এবং শিশুদের সঙ্গে বাব-মাকে বিচ্ছিন্ন করে তার অনুসৃত অভিবাসন নীতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ট্রাম্পকে অনেকটা বন্ধুহীন করে ফেলে। মানবাধিকারের চারণভূমি যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে বিশ্বে নিঃসঙ্গ হতে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশে উৎপাদন প্রক্রিয়া বেগবান হলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন শুরু হয়। পৃথিবীর অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ার পর পরিবেশবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং একসময় বিশ্বনেতারা বিশ্বকে বাঁচাতে জলবায়ু চুক্তিতে আবদ্ধ হন। প্যারিস চুক্তি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসার কথা বললে বিশ্ববাসী আহত হয় প্রচন্ডভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধের যে পরিস্থিতি চলছে, তা সামাল দিয়ে নিজেদের বাণিজ্য সুসংহত রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করবে চীন।

সম্প্রতি চীন ও ইইউর অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে মিত্রতার আহ্বান জানিয়ে নিজেদের বাজারকে আরো উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তবে চীনের অবরুদ্ধ বাজার এবং বৈশ্বিক বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্বেগের সঙ্গে একমত ইইউ। ফলে এ জোটবদ্ধতা আদৌ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের আগ্রাসী বাজার ধরার প্রক্রিয়া থামাতে ট্রাম্প প্রশাসন এই উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে হোয়াইট হাউসের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিভক্তিও রয়েছে। এক পক্ষ চাইছে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই বিশাল পরিবর্তন হোক। আরেক পক্ষ তাতে মৌন সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন বন্ধে এই যুদ্ধ কাম্য নয়।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close