নিতাই চন্দ্র রায়

  ৩০ অক্টোবর, ২০১৮

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক

এক দিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত ২টা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। এক দিন আমার মাও আমাকে বলছিলেন, ‘বাবা যাহাই করো, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরেবাংলা মিছামিছিই ‘শেরেবাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। এক দিন আমার মনে আছে, একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এসব আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমাদের দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সব সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সবাইকে খুব শ্রদ্ধা করতেনÑদাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২২)। সত্যই হক সাহেব গরিবের বন্ধু ছিলেন। ছিলেন কৃষকের আত্মার আত্মীয়। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, কৃষি ও কৃষক থাকবে, তত দিন উচ্চারিত হবে কৃষকের বন্ধু, মহান নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম।

গত ২৬ অক্টোবর, ছিল উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও কৃষক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৭৩ সালের ওই দিনে বরিশালের রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র ছেলে ছিলেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা আর ১০টা সাধারণ শিশুর মতো গ্রামের বাড়িতেই শুরু হয়। ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে তিনি শিক্ষকদের খুবই ¯েœহভাজন ছিলেন। ১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএল পাস করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিস হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। দুই বছর শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগ দেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ঋণ সালিশি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে এ দেশের কৃষককে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রজাস্বত্ব আইনপ্রণয়নের মাধ্যমে তিনি ভূমির ওপর এ দেশের কৃষকসমাজের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের কাছে শেরেবাংলা ও হক সাহেব হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতা নগরের মেয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে তিনি সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ববাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সঙ্গে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমায় এসডিও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে তখন জামালপুরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা দেখা দেয়। এ কে ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই দাঙ্গা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। জামালপুর মহকুমায় চাকরি করার সময় তিনি জমিদার সুদখোর মহাজনদের নির্মম অত্যাচার নিজ চোখে দেখেন এবং প্রতিকার করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়, পরবর্তী জীবনে তা তার খুব সহায়ক হয়েছিল। ১৯০৮ সালে তিনি এসডিওর পদ ছেড়ে দিয়ে সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রারের পদ গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকের বাস্তব অবস্থা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন। সরকারের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি ১৯১১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। কলকাতায় সেদিন তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন খাজা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ।

১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক কৃষক রাজনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৯ সালের ৪ জুলাই বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য কলকাতায় একটি সম্মেলনে মিলিত হন। ওই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলার কৃষকদের উন্নতিই ছিল এই সমিতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ১৯২৯ সালেই নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। এ সম্মেলনে এ কে ফজলুল হক সর্বসম্মতিক্রমে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ময়মনসিংহে বঙ্গীয় প্রজা সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে। এই প্রজা সম্মেলনের মাধ্যমেই পরে কৃষক প্রজা পার্টির সূত্রপাত ঘটে।

১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে পটুয়াখালীর নির্বাচনী এলাকায় এ কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ প্রার্থী ঢাকার নবাব খাজা নাজিমউদ্দিনকে সাত হাজার ভোটের ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত করেন। মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল হারিকেন এবং কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক ছিল লাঙ্গল। কৃষক প্রজা পার্টির স্লোগান ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার/ঘাম যার দাম তার।’ ওই নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ৩৯টি এবং মুসলিম লীগ ৩৮টি আসন লাভ করে। নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের সাথে সমঝোতা করে এ কে ফজলুল হক ১১ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দরিদ্র কৃষকদের ওপর কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। তিনি বিনা ক্ষতি পূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালে ‘ক্লাউড কমিশন’ গঠন করে। ১৯৩৮ সালে ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস করা হয়। ফলে জমিদারদের লাগামহীন নিষ্ঠুর অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। ১৯৩৯ সালের ‘বঙ্গীয় চাকরি নিয়োগবিধি’ প্রবর্তন করে মন্ত্রিপরিষদ মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ চাকরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে। ওই বছরই ‘চাষি খাতক আইন’-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। এতে গরিব কৃষক সুদখোর মহাজনের নির্মম নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশের আলোকে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে ‘মহাজনী আইন’ পাস করান। কৃষির আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয় তার সময়ে। পাটচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে ‘পাট অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। ১৯৫৩ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তার বাসভবনে কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে দলের নাম থেকে প্রজা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ গঠন করা হয়।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ কে ফজলুর হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল একে ফজলুল হক চার সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ছিলÑএক. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। দুই. ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা। তিন. ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ। চার. বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা। পাঁচ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি ঘোষণা এবং ছয়. জমিদারি প্রথাকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদের ব্যবস্থা।

তিনি ১৯৫৬ সালে ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয সরকার তাকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করে। এরপর তিনি তার ৪৬ বছরের বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে এ কে ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ এপ্রিল সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকার পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়। একই স্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমউদ্দিনের সমাধী রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে জাতির সহায়তায়। মহত্ত্ব নিয়ে অনাসক্ত হয়ে ব্যক্তি সত্তার স্বকীয়তা ভুলতে হবে; লুপ্ত করতে হবে। জাতির স্বার্থ হবে ব্যক্তির স্বার্থ। জাতির কল্যাণেই ব্যক্তির কল্যাণ।’ আমরা যদি মহান নেতার এই উপদেশ মনে-প্রাণে পালন করি, তাহলেই দেশ ও জাতি উপকৃত হবে এবং তার প্রতি জানানো হবে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close