আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

বিশ্বায়নে আরবি ভাষা

মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা ব্যবহার করে থাকে। পৃথিবীতে যেদিন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, সেদিন থেকেই তার মুখে ফুটে উঠেছে ভাষা। প্রথম সৃষ্ট মানব-মানবি হজরত আদম ও হজরত হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে পরীক্ষার জন্য সর্বপ্রথম যে শব্দজ্ঞান ও ভাষা শেখানো হয়েছিল, তা হলো আরবি আর এতে কোনো দ্বিমত নেই। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘জান্নাতে হজরত আদম (আ.)-এর ভাষা ছিল আরবি। কিন্তু ভুলবশত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর তিনি আরবি ভাষা ভুলে যান। এরপর যখন তওবা কবুল করা হয়, তখন থেকে পুনরায় আরবি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হন, (আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন : ১/১৩৬)। হজরত আদম (আ.)-এর সন্তানরা মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে সভ্যতা গড়ে তোলে, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই আরবি ভাষা।

আরবি ভাষা পৃথিবীর একটি পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা। আরবি ভাষার ন্যায় এত মোহনীয়, সুমিষ্ট, চিত্তাকর্ষক ভাষা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই মানুষের শিক্ষার ভাষা আরবি হওয়াটা অধিকতর যুক্তিযুক্ত। কেননা, জ্ঞানের উৎস হচ্ছে কোরআন ও হাদিস। কোরআন ও হাদিসের ভাষা হচ্ছে আরবি। আর এ দুটোই মানুষের একমাত্র পাথেয়; যা রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন। আরবি ভাষা সরবাধিক চর্চিত ভাষা, যে কারণে তা সর্বকালের এবং সর্বস্থানের জন্য উপযোগী। এ ভাষা নির্গমনের গুণে গুণান্বিত। একটি শব্দ হতে সংখ্যাতীত শব্দ নির্গত করা সম্ভব। শব্দ ভা-ার ও অর্থের দিক দিয়ে এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভাষা। আরবি একই শব্দের বহুবিধ অর্থের গুণেও গুণান্বিত। এ ভাষার বিশেষ গুণ হলো, আরবি শব্দের কতিপয় বৈশিষ্ট্যের কারণে যৌথ শব্দ ব্যবহার না করে একক শব্দ দ্বারাই একাধিক অর্থ প্রকাশ সম্ভব। বিভিন্ন শিরোনামে এ ভাষার শব্দাবলি বহুবিধ অর্থ প্রদানে সক্ষম; যা অন্য কোনো ভাষায় সক্ষম নয়। এটি কেবল আরবি সমর্থক শব্দের আধিক্যের কারণেই সম্ভব। সুতরাং, এসব কারণে শিক্ষার মাধ্যম আরবি ভাষা হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করি।

আরবি ভাষা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। জাতিসংঘ যে কয়টি ভাষার অনুমোদন করেছে, আরবি তন্মধ্যে চতুর্থ। ফলে আরবি ভাষার প্রয়োগক্ষেত্র দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আরবি ভাষার প্রয়োগ তুলনাহীন। আরবি ভাষাভাষী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষা জানতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী, খাদ্য ও পানীয়, দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য নানান বস্তু, বাচ্চাদের খেলনা, গাড়ির পার্টসসহ অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ইংরেজি বা অন্য ভাষার পাশাপাশি আরবিতে লেখা হচ্ছে। সম্প্রতি আরবি ভাষার প্রয়োগক্ষেত্র আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রচারমাধ্যমগুলো নিয়মিত আরবিতে সংবাদ পরিবেশন করছে। অন্যান্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের ন্যায় এখন আরবিতে পত্রিকা ও ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হচ্ছে।

আরবি ভাষা হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। কেননা, আরবি ভাষা ছাড়া মানুষ জ্ঞানকে পরীক্ষা করতে পারে না। দ্বীনের বুৎপত্তি জ্ঞান অর্জন করতে হলে আরবি ভাষার বিকল্প কোনো ভাষা নেই। মধ্যযুগ তথা আব্বাসীয় আমলে মুসলমানরা যখন একের পর এক এলাকা জয় করতে থাকে এবং বিভিন্ন জ্ঞান ও কৃষ্টিকালচারের সম্মুখীন হয়, তখন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা গবেষণা ও অনুশীলন আরম্ভ করে; যার ফলশ্রুতিতে তারা অংক, চিকিৎসা, দর্শন, তর্ক, ভূগোল শাস্ত্র আবিষ্কার করে। আরবি ভাষাটি কবেল গদ্য আর পদ্যে সীমিত নয়, বরং এতে রচিত হয়েছে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ, কর্ম, শিল্পকলা ও রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি। আরবি ভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যের ভাষা। ইসলামকে জানতে হলে সর্বপ্রথম যাদের কাছে ইসলাম এসেছে, তাদের অবস্থা ভালোভাবে জানতে হবে। আরব দেশ যেহেতু ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু, সেহেতু ইসলামকে জানার জন্য আরবদের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে হবে। মোদ্দাকথা ইতিহাস জানতে হলে আরবি ভাষা শিখতে হবে।

ধর্মীয় দিক থেকে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। সালাত, সওম, জাকাত, হালাল-হারাম, জায়েজ-নাজায়েজÑএগুলো জানা এবং পালন করা মানব জাতির ওপর অবশ্যই করণীয়। আর এগুলো জানার মাধ্যম হলো পবিত্র কোরআন-হাদিস। জ্ঞানের উৎসসূচক এ দুটির মাধ্যম হলো আরবি। তাই কোরআন-হাদিস বুঝতে হলে আরবির বিকল্প নেই। তাছাড়া আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের ধর্মের অনুশীলন দেখতে পাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিচারালয়। মানুষের একমাত্র আইন বা বিধান হলো আল-কোরআন; যার ভাষা আরবি। মানুষ জীবনের চলার পথে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়, যার জন্য বিভিন্ন মাসা’আলা জানা প্রয়োজন আর মাসআলা-সংক্রান্ত গ্রন্থ হলো ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহ। এসব গ্রন্থও আরবি ভাষায় রচিত। জান্নাতিদের ভাষা আরবি। মুমিনের চিরকাম্য হলো জান্নাত। তাই জান্নাতের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা করলে ওই জ্ঞান পরিপক্ক হবে না।

বর্তমান বিশ্বে হাজার হাজার ভাষা রয়েছে, রয়েছে বিচিত্র বর্ণের ও গোত্রের মানুষ। সময়ের পালাবদলে ভাষারও শৈল্পিক বিবর্তন হয়েছে। ভাষার এ বৈচিত্র হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাভাবিকতার মধ্যে অস্বাভাবিক পৃথিবীর সর্ব প্রাচীনতম ভাষা আরবিও আজ স্বমহিমায় ভাস্মর হয়ে আছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র। কালের স্রোত, সময়ের আবর্তন কোনো কিছুই আরবি ভাষার অবিচল ও অবিশ্রান্ত গতিধারাকে স্তব্ধ করতে পারেনি।

আসলে মুসলিমরাই আরবি ভাষার ধারক ও বাহক। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে এই আরবি ভাষাকে বিশ্বায়নের জন্য যেভাবে কাজে লাগানোর দরকার ছিল, সেভাবে সর্বক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাদের মধ্যকার অনৈক্য, ভুল বোঝাবুঝি, আধুনিকতার ছদ্মাবরণে ভিন্ন জাতির গোলামি স্বীকার করাসহ আরো নানাবিধ কারণে মুসলমান হয়তো তাদের ভাষার প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করতে পারেনি। তবে এ ক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মুসলমানদের এই উদাসীনতার পরও বর্তমান বিশ্বায়নের এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই, যেখানে আরবি ভাষার কদর নেই। সুতরাং, আরবি ভাষা এমন এক ক্ষরস্রোতা নদীর নাম; যার চলার পথ তৈরি করতে অন্য কারো প্রয়োজন পড়ে না।

বর্তমান বিশ্বসভায় মুসলমানদের সংখ্যা ১৩০ কোটিরও বেশি; যা বিশ্বের মোট জনসমষ্টির ছয় ভাগের একভাগ। এই বিশালসংখ্যক মানুষের অধিকাংশের ভাষাই আরবি। এ ছাড়া যাদের ভাষা আরবি নয়, তারা মুসলমান হওয়ার কারণে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আরবি ভাষা চর্চা করে চলছে। সুতরাং, এই বিরাট অঙ্কের মানুষের হৃদয়ের ভাষা আরবিকে বাদ দিয়ে বিশ্বায়নের কথা কল্পনাই করা যায় না। বিশ্বে যতগুলো ভাষা আছে, তন্মধ্যে আরবি ভাষা সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ভাষা। এর প্রাঞ্জলতা, সাবলীলতা, ভাবগাম্ভীর্য, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা সবকিছুই এ ভাষাকে পৃথিবীর অন্য সব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে। সুতরাং, মর্যাদার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন মর্যাদাপূর্ণ ভাষার যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ্বায়ন পরিকল্পনা অবান্তর।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close