নিতাই চন্দ্র রায়

  ২২ অক্টোবর, ২০১৮

পরিবেশ

জলবাযু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও এর প্রভাবে সব চেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো। এগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ হবে মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ এবং ২১০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে ক্ষতির পরিমাণ ২১০০ সাল পর্যন্ত জিডিপির ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে। ‘জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় নিরূপণ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত। অত্যধিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, দাবদাহ এবং উৎপাদন মৌসুমের সময় কমে যাওয়ার মতো কারণে চাল, গম ও আলু উৎপাদন বর্তমান সময়ের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপন, নদী-নালা, খাল-বিলে শিল্পবর্জ্য ফেলা, জলাশয় ভরাট, বন ও বৃক্ষ উজার করার মতো কাজগুলোও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিনষ্টের জন্য কম দায়ী নয়। দেশের ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি উপকূলীয় অঞ্চলে তিন কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের বর্তমানের চেয়ে বেশি ঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর কৃষিজমি নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। ফসলের উৎপাদন মারাত্মক হ্র্রাস পাবে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে, তা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খুলনা বিভাগ সবচেয়ে বেশি। এতে ঢাকা বিভাগের ১৪ শতাংশ জায়গা তলিয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় এলাকার সম্পদও বিনষ্ট হবে প্রচুর। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত মোকাবিলার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় এখন থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর কমপক্ষে ৭৩ বিলিয়ন ডলার বা এ অঞ্চলের মোট জিডিপির দশমিক ৮৬ শতাংশ ব্যয় করতে হবে।

শিক্ষা, স্বাস্থ, অবকাঠামো ও আর্থসামাজিকসহ বিভিন্ন খাতের খসড়া হিসাব করেই সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কমানোর জন্য দুই ধরনের উপায় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এক. বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, যা বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা কার্বন নির্গমণ হ্রাসে বাস্তব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই তা সম্ভব, দুই. উন্নত দেশগুলোর দেওয়া জলবায়ু তহবিলের অর্থ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির কমিয়ে আনা। এ জন্যও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। জলবায়ুর বিরূপ আচরণের কারণে বন, জলাভূমি এবং বিশ্বের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ২০৩০ সালে বছরে আট কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০৫০ সালে বছরে ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে বলে উলেখ করেছে এডিবি।

এখন প্রশ্ন হলো জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ কী এত বিপুল অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হবে? এডিবির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ২০৫০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোতে সম্মিলিতভাবে জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। তবে বিশ্ব যদি এখনকার প্রাকৃতিক জ্বালানিকেন্দ্রিক পথ ধরে চলতে থাকে, তাহলে ২১০০ সালে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশে। প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপ তুলে ধরে এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট বিন্দু লোহানি বলেন, এশিয়ার সব দেশ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রভাবে ধানের উৎপাদন ২৩ শতাংশ কমে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে এই অঞ্চলে সাড়ে ৯ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর বাইরে আরো ১০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে। তা ছাড়া এর প্রভাবে জ্বালানি ও পানি সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের একার পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রতি বছরই ৬ শতাংশের বেশি করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে উৎপাদনের বড় একটা অংশ ক্ষতি হলে দারিদ্র্য দূর করতে একটু বেশি সময় লাগবে। জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জীবনমান চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মালদ্বীপ ও নেপাল। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে মালদ্বীপ তার মোট দেশজ উৎপাদনের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ হারাবে। আর নেপাল হারাবে তার মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৬ ও শ্রীলঙ্কা জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারাবে। জরাবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব এবং মোকাবিলায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেওয়া পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে। ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় বর্তমান সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ পানি প্রবাহ ও কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে। গবেষকরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেমন শস্য উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, তেমনি এই অববাহিকায় অবস্থিত দেশসমূহের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এখন থেকেই গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে।

জলাবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি হতে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য সরকার ব্যাপক ভিত্তিতে বৃক্ষরোপণের কমৃসূচি গ্রহণ করেছে। একই কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, ভুট্টা, সুগারবিট, আখ, সূর্যমুখীর মতো ঘাত সহিষ্ণু ফসল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে তাপ ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ফসলে জাত উদ্ভাবন এবং উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার। প্রয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শস্য বিন্যাস ও শস্য ক্রমের পরিবর্তন করতে হবে। উদ্ভাবন করতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাত সহিষ্ণু গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ ও জলজ প্রাণীর নতুন নতুন জাত ও লালন-পালনের নতুন কৌশল। সেই সঙ্গে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। বিশ্বের সব দেশে যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০সালের মধ্যে ২ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার রক্ষা করে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে থাকবে। আর ২১০০ সালের মধ্যে তা বেড়ে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ হাজার ৬ লাখের মধ্যে। এ হিসেবে দেশগুলোর মোট জিডিপি দশমিক ৪৮ শতাংশের মধ্যেই থাকবে ক্ষতির পরিমাণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। গ্রাম ছেড়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেবে। তাদের খাদ্য-পুষ্টি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিও গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য অন্যতম দায়ী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারা সৃষ্ট হলেও নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সে অনুযায়ী সাহায্য পাওয়া যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতি বছর প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নয়। এটি এখন এক ভয়াবহ বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই মানব জাতির অস্তিত্ব ও টিকে থাকার স্বার্থে এই সমস্যা মোকাবিলায় সব দেশকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close