শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

  ২১ অক্টোবর, ২০১৮

স্বাস্থ্য

সংকোচ নয় সচেতনতা জরুরি

প্রতি বছরের মতো এবারও ১০ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট আনন্দ-উৎসাহে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার দূর করা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ কর্তৃক ১৯৯২ সাল থেকে ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের সূচনা হয়। বর্তমানে বিশ্ব¦ব্যাপী ৪৫ কোটি জনগণ মানসিক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এর বাইরে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত যে বিষয়টি ঠিক রোগের পর্যায়ে পড়ে না। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬ ভাগ ও শিশু-কিশোরদের শতকরা ১৮ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিপুল এ জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ অনেক সময় প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও চিকিৎসাপ্রাপ্তির তথ্যের অভাবে সময়মতো চিকিৎসাসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে জনগণের কর্মক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। এর অন্যতম কারণ মানসিক স্বাস্থ্য, রোগ ও এর চিকিৎসার প্রতি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাজে মর্যাদাবোধের অভাব লক্ষ করা যায়। এ জন্য অনেকে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেওয়াকে সামাজিকভাবে লজ্জাকর মনে করেন যেটি শারীরিক রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কিন্তু সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেক সময় রোগী ও পরিবারের সদস্যরা খারাপ আচরণের শিকার হন। এ জন্য পারস্পরিক শ্রদ্বাবোধ বজায় রাখা জরুরি।

মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ বিষয়টি শুধু রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ ব্যাপক। মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া জোর করে আটকে রাখা মর্যাদাহানিকর। নিম্নমানের সেবা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া এসব বিষয় মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়টি খেয়াল করে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত রোগ নির্ণয় করে তাকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। কারণ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও দুই-তৃতীয়াংশ মানসিক রোগী চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত। পরিহাসের বিষয়, উন্নত দেশের অবস্থা এর চেয়ে বেশি ভালো নয়। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ সিজোফ্রিনিয়া রোগী চিকিৎসাসেবা পায় না। এর প্রধান কারণ, মানসিক রোগ চিকিৎসায় জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের জন্য সহজে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, মনোবিদ ও অন্যান্য সহায়ক পেশাজীবী ও চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট সবার সমন্বি^ত প্রচেষ্টা জরুরি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর ব্যক্তিগত চাহিদা ও তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সম্মান প্রদান ও ব্যক্তিমর্যাদাকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। রোগের নিরাময় ধারণাটিও নতুনভাবে এসেছে, যেখানে রোগের উপশম হওয়ার পর ব্যক্তি আত্মবিশ্বাস, মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনসহ সামাজিক কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ তৈরি মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যদূরীকরণ ও জনগণের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ জন্য জনসচেতনতা বিশেষত স্কুল, কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন ও এ বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

মানসিক রোগ বা এর চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যাপারে এ দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা এখনো সুস্পষ্ট নয়। প্রকৃত অর্থে মানসিক রোগ অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই এক ধরনের অসুস্থতা। প্রাচীনকালে মানসিক সমস্যাসমূহে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ‘পাগল’ বলা হলেও, বর্তমানে বিজ্ঞানের আশীর্বাদে যেকোনো মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, যেকোনো দেশে গুরুতর মানসিক রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ এবং লঘু মানসিক রোগীর সংখ্যা শতকরা প্রায় ১০ শতাংশ। এ সংক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা তাদের অধিকার। আধুনিক বিশ্বে সাইক্রিয়াটির বিভিন্ন ধরনের নিত্যনতুন শাখা বা ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে। অন্যদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকাসক্তি, নারী ও শিশু নির্যাতন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রভৃতি কারণে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ চাপের সঞ্চার হয়। বিভিন্ন অর্থ-সামাজিক ও শারীরিক কারণে প্রবীণদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার প্রবণতা অন্য বয়সের তুলনায় বেশি বলে এক জরিপে দেখা গেছে। এসব সমস্যা উন্নত বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রকট। এর প্রধান কারণ হলো ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির প্রভাব। অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এর বিস্তৃতি আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমতাবস্থায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও মানসিক রোগীর স্বাস্থ্য সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট। কারণ, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে দেশের মূল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক তথা সঠিক উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। দেখা গেছে, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির কর্মক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। পারিবারিক দায়িত্ববোধ ও সন্তান লালন-পালনে তারা অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধার সম্মুখীন হন। মানসিক রোগীরা সাধারণত পরিবার, বন্ধু বা রাষ্ট্রের ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের ১৯৯৩ সালের এক রিপোর্টের আলোকে জানা যায়, মানসিক, স্নায়ুবিক ও আচরণগত সমস্যার কারণে মানুষের কর্মক্ষম জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধা অনেক সীমিত। ২০০০ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল তৎকালীন প্রেক্ষাপটে প্রতি ১৯ লাখ মানুষের জন্য বাংলাদেশে রয়েছেন মাত্র একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগীর ডাক্তার। জনগণের সামাজিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শেরেবাংলা নগরে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তা ছাড়াও ঢাকার তেজগাঁওয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবিক রূপে এগুলোর কার্যক্রম কতটা ফলপ্রসূ? এসব কেন্দ্রে সুচিকিৎসার কোনো লক্ষণ তো নেই-ই বরং এসব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দালালদের এক ধরনের সিন্ডিকেট, যারা অসহায় রোগী বা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে যেভাবেই হোক টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু আমাদের নিতান্তই দুর্ভাগ্য, এসব বিষয় সবার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়।

আরেকটি বিষয় হলো প্রাইভেট ক্লিনিক। যেহেতু আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডাক্তারের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সেহেতু নিজস্ব ক্লিনিক খুলে এই ডাক্তারদের অনেকেই অবতারণা করেছেন সেবার নামে প্রতারণার জাল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানি। মানসিক রোগের চিকিৎসায় এখন এমন কিছু ওষুধ রোগীদের সেবন করানো হয়, যেগুলো পরে রোগীকে নেশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর নানাবিধ প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে ডাক্তাররা এ ধরনের ওষুধ সেবনে রোগীদের বাধ্য করেন। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিকসমূহের ব্যয়ভার এ দেশের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকেই পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পাওয়া থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়গুলোর প্রতি সরকার যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানসিক রোগ কোনো ভয়ংকর রূপ লাভ করতে পারবে না।

মানসিক রোগীকে দূরে ঠেলে না দিয়ে, তার বা তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাই এখন সময়ের দাবি। আর এ লক্ষ্যে প্রয়োজন সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে, সৃজনশীল সমাজ গঠনের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও নির্মল পৃথিবী উপহার দেওয়া।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close