সাধন সরকার

  ২০ অক্টোবর, ২০১৮

স্মরণ

জগন্নাথ বিদ্যাপীঠের ১৩ বছর

২০ অক্টোবর ‘জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় দিবস’। একে একে ১৩টি বছর পার করল উচ্চশিক্ষা বিস্তারে সময়ের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় (জবি)। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর একরাশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটিকে কলেজ থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। পথচলার শুরুতে নানাবিধ সংকট থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ ও আধুনিক বিশ^বিদ্যালয়ের যেসব শর্তাবলি আবশ্যক, সে পথেই রয়েছে বিশ^বিদ্যালয়টি। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, যুগোপযোগী জ্ঞান বিতরণ, অগ্রসরমান বিশে^র সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন, আধুনিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চা, বর্তমান ও ভবিষ্যত নেতৃত্ব প্রদানে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এ বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়টিতে ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমানে এ বিশ^বিদ্যালয়ে প্রায় ২২ হাজার ছাত্রছাত্রী, প্রায় ৬০০ জন শিক্ষক ও প্রায় ৬২০ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।

এবার আসা যাক শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার কথায়। যাতায়াত ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের পরিবহন সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ^বিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যানটিনও নানা সমস্যায় নিয়মিতভাবে খোলা থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, দেশসেরা অন্যতম এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্র্থীরা শুরু থেকেই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আবাসন সংকটের সমাধানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন এ ব্যাপারে বরাবরই উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে! বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে পুরাতন হলগুলো নানাভাবে হাতছাড়া হয়েছে অনেক আগেই। অথচ, ভারতবর্ষে সবচেয়ে আবাসিক সুবিধা সংবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল তৎকালীন ‘জগন্নাথ কলেজ’। প্রশ্ন হলো, অন্যান্য পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সুবিধা পেলে এ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে কেন? নানা সমস্যা মোকাবিলা করে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থীকে থাকতে হচ্ছে বিভিন্ন ভাড়া বাসায় মেস করে। যদিও ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রস্তাবিত জমির ওপর বিশ^বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সমস্যার সমাধান ও নানা সুবিধার কথা বলা হচ্ছে। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসকে সম্প্রসারণ ও উন্নত করতে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। যত দ্রুত আবাসন সংকটের সমাধান করা যাবে, তত দ্রুত শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের একমাত্র খেলার মাঠও খেলার জন্য অনুপযোগী। মাঠটিতে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাঠটির বেহাল দশা। মাঠটি সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

অতি দুঃখের বিষয়, প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১৩টি বছর পার করলেও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো সমাবর্তনের (প্রথম) আয়োজন করতে পারেনি। সব কটি বিভাগ মিলিয়ে ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ (কেননা ০৩-০৪ ও ০৪-০৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বিশ^বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়) প্রথম ৮টি ব্যাচের স্নাতকোত্তর মিলিয়ে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্র্থী (০৩-০৪ ও ০৪-০৫ ব্যাচের প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থীসহ) বিশ^বিদ্যালয় থেকে সর্ব্বোচ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে গেলেও তারা কেউই সমাবর্তনের (কনভোকেশন) মুখ দেখেননি। বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন থাকে সমাবর্তনে অংশ নেওয়া। শিক্ষাজীবন শেষে একজন শিক্ষার্থী গায়ে কালো গাউন, মাথায় সমাবর্তন ক্যাপ (হ্যাট) পরে আচার্যের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। সমাবর্তন না হওয়ায় সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে! সমাবর্তন ছাড়াই প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েটদের সাময়িক সনদ নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় ছাড়তে হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সমাবর্তনের দাবি জানালেও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতের কথা বলে আসছে! কখনো জায়গার অভাব আবার কখনো বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার বিষয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে আর কত কালক্ষেপণ? যথাসময়ে সমাবর্তন না হওয়ায় বিশ^বিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করা গ্র্যাজুয়েটদের সমাবর্তনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয় জীবনে বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাবর্তনের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন শিক্ষার্র্থীর বুকে লালিত স্বপ্ন হলো কনভোকেশন। এ স্বপ্ন শিক্ষার্র্থীদের লেখাপড়ায় শক্তি জোগায়, উজ্জীবিত করে। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে বিশেষ করে পাশ্চাত্যের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিয়মিতভাবে সমাবর্তনের আয়োজন হচ্ছে। এমনকি আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশে স্কুল জীবন শেষেও কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সমাবর্তনে পড়ালেখা শেষ করা শিক্ষার্থীরা শুধু সনদপত্র গ্রহণ করে তা নয়, সমাবর্তন শিক্ষার্থীদের দেশ ও জাতির সেবা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মানবকল্যাণে নিবেদিত করার প্রেরণা দিয়ে থাকে; যা সে তার কর্মজীবনে প্রয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি বিশ^বিদ্যালয়ে এক বা একাধিক সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (ঢাবি) প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এরপর থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত একটানা সর্বমোট ২৪ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে যদি একটানা সমাবর্তন (ঢাবিতে) করা সম্ভব হয়, তাহলে বর্তমান সময়ে জবিতে এক যুগ পরেও কেন সমাবর্তন আয়োজন করা সম্ভব নয়? অতি সম্প্রতি ‘ঢাবি’র ৫১তম সমাবর্তন হয়ে গেল। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের পরে বা কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত এমন বেশ কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে এক বা একাধিকবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যাই বলা হোক না কেন, মোটকথা হলো সদিচ্ছা। ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে সমাবর্তন আয়োজন করা খুব কঠিন কাজ নয়! জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে প্রতি বছর যথাসময়ে সমাবর্তনের অয়োজন করা। সবশেষে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনেরও উচিত শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট সমাধান ও সমাবর্তন আয়োজনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। এ দুটি সমস্যার সমাধান হলে শিক্ষার্র্থীদের অনেক দিনের সমস্যার সমাধান যেমন হবে তেমনি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ আরো উন্নত হবে বলে মনে করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close