নিতাই চন্দ্র রায়

  ২০ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী এবং সমাজব্যবস্থা

বিশ্বের সব মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পৃথিবীতে প্রায় ৬ দশমকি ৫ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন দরিদ্র্য মানুষ খাদ্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করছে। তাই বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কর্মসূচি ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনাহারী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য, খাদ্যদ্রব্যের অসম বণ্টন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতিগত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে তা আগামী ২০৫০ সালের আগে অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানান জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান।

পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করতে হলে আমাদের যে কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে, সেগুলো হলো-১. খাদ্যের অপচয় বন্ধ করতে হবে, ২. অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে, ৩. খাদ্যের সুসম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে, ৪. দারিদ্র্য দূর করতে হবে, ৫. জাতিগত সংঘাত ও যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, ৬. ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে, ৭. অধিক স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, ৮. কমসংখ্যক উপকরণ ব্যবহার করে সহজে ও অল্প সময়ে পুষ্টিকর খাদ্য তৈরির কৌশল আয়ত্ত করতে হবে, ৯. খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক চিন্তাভাবনাকে নিকটবর্তী স্থানীয় ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে, ১০. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষামূলক কর্মসূচি তৈরি করে তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীবৈচিত্র্য সংরক্ষণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে এ কথা সর্বৈব সত্য যে, শুধু খাদ্যের সুসম বণ্টন নিশ্চিত করা গেলে এ মুহূর্তেই পৃথিবীর অনাহারি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হতো। ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় তা সম্ভব নয় বলেই জাতিসংঘকে তার কর্মসূচিকে ১৫ থেকে ৫০-এ স্থানান্তর করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলেই অনেকের বিশ্বাস।

এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো-(our action our future, A zero hunger world by 2030 is possible) ‘কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব।’ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীন। ১০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। শুধু যুদ্ধগত কারণেই নয়, সব দেশেরই বৃহদাংশ মানুষের জীবন অনাহার ও অপুষ্টির নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। এই ক্ষুধাতুর ও বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের শ্রম-ঘামের সুফল ভোগ করছে উঁচুতলার একভাগ মানুষ। মাত্র কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর বেশির ভাগ সম্পদ। ক্ষুধা, অসাম্য, অপচয় আর যুদ্ধের করতলে পৃষ্ঠ পৃথিবী কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা চাই মানবিক ও শান্তির সমাজ। প্রকৃত গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির সমাজ। শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের জন্য আমাদের নিষ্ঠার কাজ করে যেতে হবে। মানবসৃষ্ট ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রাণঘাতী যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সবার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্ব অনাহার সূচক ২০১৭ অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনাহারী মানুষের ১০টি দেশ হলো-সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চাঁদ, সিরিয়া লিয়েন, মাদাগাস্কার, জাম্বিয়া, ইয়েমেন, লাইবেরিয়া সুদান, নাইজার ও তিমুর-লেস্তে। সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দেশ। জাতিগত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটিতে ২০১২ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদনে ধস নামে। ফলে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ অনাহার ও অপুষ্টির শিকার। দীর্ঘ খরার কারণে চাঁদে প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত। আঞ্চলিক সংঘাতের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীরা দেশটির খাদ্যাভাবকে আরো প্রকট করে তুলেছে। প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে সিয়ার লিয়নে অনাহারি ভুখানাঙ্গা মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে ৩ দশমকি ৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার দেশটিতে। দীর্ঘ এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধই দুর্ভিক্ষের কারণ। তীব্র খরাই মাদাগাস্কার খাদ্যাভাবের মূল কারণ। দেশটিতে ১ দশমকি ৪ মিলিয়ন মানুষ অনহারের শিকার। দেশটির অর্থেক শিশু অনাহার অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৫ বছর বয়সের নিচের অর্থেক শিশু খর্বাকার। জাম্বিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ অনাহারে ভুগছে। সেখানে শতকরা ৫০ভাগ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে খর্বাকৃতি। ইয়েমেনে দীর্ঘ এক দশকব্যাপী যুদ্ধের কারণে ১৭ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের অভিশাপের শিকার। সুদানেও একই কারণে ৩ দশমকি ৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার। এ ছাড়া দক্ষিণ সুদান থেকে আসা শরণার্থীরা এ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। লাইবেরিয়ার শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাদের প্রায় সবাই অনাহারে দিন কাটায়। এর প্রধান কারণ ইবোলার প্রাদুর্ভাব। পরপর কয়েক বছর ধরে খরার কারণে নাইজারে ১ দশমকি ৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার। তিমুরলেস্তে ১ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি ক্ষুদ্র দেশ। দেশটির প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ ক্ষুধার শিকার এবং শতকরা ৫০ ভাগ শিশু খর্বাকার।

২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শতকরা ২৭ ভাগ হ্রাস পেলেও সারা পৃথিবীতে এখনো ৮ দশমকি ৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রনায় কষ্ট পায়। বৈশ্বিক অনাহার সূচক-২০১৭ অনুসারে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে অপুষ্টিজনিত কারণে। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি লোক অপুষ্টিতে ভুগছে। গত ১০ বছরে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭ লাখ। দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্থ’লতার প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে দেশে শিশু ও নারীর পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছ্।ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বখাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থির এই তথ্য পাওয়া যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘের কৃষি উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইফাদ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ। বর্তমানে বিশ্বে ৮১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। প্রতিবেদনে ২০০৫ সালের তথ্যের সঙ্গে ২০১৬ সালের তথ্যের তুলনা করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী খর্বাকৃতি শিশু ৪৫ শতাংশ থেকে কমে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০০৪ সালে বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার মানুষ ছিল ২ কোটি ৩৭ লাখ। এখন ২ কোটি ৪৪ লাখ; যা মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। ১০ বছর আগে এটি ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অপুষ্টির শিকার মানুষের মোট সংখ্যা বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে তা কমেছে। ভারতে অপুষ্টির শিকার মানুষের হার ২০০৬ সালে ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ; যা ২০১৬ সালে কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারের অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের হার কমছে বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত গতিতে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে বিশ্বে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৭৭ লাখ থেকে বেড়ে ৮ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার হয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ৫ বছরের কম বয়সী ১৫ কোটি ৫০ লাখ শিশু খর্বাকৃতির ৫ কোটি শিশু কৃশকায়, যাদের ২ কোটি ৭৬ লাখ দক্ষিণ এশিয়ায়।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close