আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নদীদূষণ

সারা দেশে প্রায় দুই হাজার শিল্পকলকারখানা আছে। অর্ধেকের বেশি ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করেনি বা সবসময় চালু রাখে না বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শিল্পবর্জ্যের বড় শিকার হচ্ছে রাজধানী বা শিল্প এলাকার নদীগুলো। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, হালদা, কর্ণফুলী, সুরমা, রূপসা কিংবা ব্রহ্মপুত্র কোনো নদীই রেহাই পাচ্ছে না এ দূষণের হাত থেকে। শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দূষণের ভয়াবহতাও বাড়ছে। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত তরল বর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক এবং অন্যান্য মানুষের বর্জ্য ইত্যাদির মাধ্যমে নদী-খাল ইত্যাদি দূষণ হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশেরপাশের জেলার নদী-খাল, বায়ু দূষণ হচ্ছে। পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনানা থাকায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ বা শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত করছে। এসব শিল্প কলকারখানার বেশির ভাগই শব্দ দূষণ করছে। কলকারখানার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে শিল্পবর্জ্যরে পরিমাণও বাড়ছে। কিন্তু সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যপারে কারো বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট শিল্পমালিকের তেমন মাথা ব্যথা নেই। পানির ঢলে শিল্পবর্জ্য হালদায় পড়ে নদী দূষণ হচ্ছে। ফলে এলাকার অন্যতম বৃহত্তম প্রাকৃতিক মাছের অভায়ারণ্য হুমকির মুখে। চট্টগ্রামের বায়েজিদ থেকে কুলগাঁও-নন্দীরহাট পর্যন্ত শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য হালদা সংযুক্ত খাল ও সংযুক্ত পরিত্যক্ত জমিতে পড়ছে। এর ফলে বর্ষাকালে বা বন্যার সময় খাল বেয়ে হালদার পানিতে পড়ছে এসব বর্জ্য। এতে ফসল নষ্ট হচ্ছে, মাছ মরছে। দূষণ হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে স্বাস্থঝুঁকি। শিল্পবর্জ্য ও দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নরসিংদীর ব্রহ্মপুত্র নদ। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বিষাক্ত বর্জ্য এ এলাকার পানির রং পাল্টিয়ে দিচ্ছে। ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। কোথাও পানির রং লাল হয়ে গেছে আবার কোথাও কালচে হয়ে যাচ্ছে পানির রং। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এখান থেকে শিল্পবর্জ্য ধলেশ্বরীতে পড়ছে। এর ফলে এ নদীসহ আশেপাশের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। হবিগঞ্জে শিল্পকারখানা স্থাপন হচ্ছে। এখানকার অনেক শিল্পবর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। মরতে বসেছে এ নদী। জমিতে দূষণ হচ্ছে। খুলনার খালিশপুর বা রূপসার আশেপাশের কারখানার বর্জ্য রূপসা নদীকে দূষণ করছে। চট্টগ্রামের কলকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীর দূষণের ভয়াবহতা বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাত হচ্ছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। পোশাক কারখানা বা এর সংশ্লিষ্ট কারখানাতেই দূষণ বেশি। সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে চামড়াশিল্প খাত। এখানেও দূষণের মাত্রা বেশি। কারণ, এখানেও পরিকল্পনার অভাব। ২০১৬ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ঘনমিটার এবং পরের বছর ২৩ কোটি

৮০ লাখ ঘমিটার বর্জ্য নিঃসরণ হয়েছে বস্ত্র ও

পোশাকশিল্প থেকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি বছর শেষে বস্ত্র শিল্পের বর্জ্য পানির পরিমাণ দাঁড়াবে

২৬ কোটি ৩০ লাখ ঘনমিটার। ২০২১ সালে এটি ৩৪ কোটি ঘনমিটার ছাড়াবে। ‘ইভ্যালুয়েশন অব প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার ওয়েস্ট ওয়াটার ই¤প্যাক্টস অব টেক্সটাইল ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।

বুয়েটের এ গবেষণায় বলা হয়, পরিবেশের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে বস্ত্র শিল্পে ব্যবহৃত পানি ও সেখান থেকে নিঃসরিত বর্জ্য। এ শিল্পের কারখানায় উৎপাদিত প্রতি ইউনিট কাপড়ে ভালো মাত্রায় পানির ব্যবহার হয়। এর প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ব্যাপক হারে কমছে। আবার বস্ত্র শিল্পকারখানা থেকে নির্গত পানি কোনো পরিশোধন ছাড়াই নদী ও শুকনো জমিতে গিয়ে মিশছে। এ অপরিশোধিত বর্জ্য পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বস্ত্রশিল্প অধ্যুষিত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর অঞ্চলগুলোর নদী ও পানি সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হচ্ছে।

গবেষণায় ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বস্ত্রশিল্পের দূষণ প্রবণতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এক দশকের দূষণের পরিমাণ ও মাত্রা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের কারখানায় ১৮ কোটি টন কাপড় উৎপাদন হয়েছে, যার মাধ্যমে উৎপাদিত বর্জ্য পানির পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ৭০ লাখ ঘনমিটার। ২০২১ সালে এ বর্জ্য পানির পরিমাণ ৬০ শতাংশ বেড়ে গিয়ে হবে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটার। যদিও যথাযথ প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বর্জ্য পানির পরিমাণ ২৩ শতাংশ কমানো সম্ভব বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদী দূষণের কারণে ওই অঞ্চলে দূষিত পানি ব্যবহার করার ফলে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সালে নিট শিল্প থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পানির পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৫০ লাখ ঘনমিটার। ওই বছর ওভেন শিল্পের উৎপন্ন বর্জ্য পানির পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ঘনমিটার। ২০১৭ সালে নিট শিল্পের উৎপন্ন বর্জ্য পানির পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ ঘনমিটার, ওভেন পণ্য থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পানির পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ৪০ লাখ ঘনমিটার। ২০২১ সালে নিট ও ওভেন পোশাক থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পানির পরিমাণ হবে যথাক্রমে ১৬ কোটি ৭০ লাখ ও ১৮ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার। বাস্তবতা হলো, পানি শোধন ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ব্যবস্থা অকার্যকর থাকে। ফলে দেশে পানি দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনো কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি।

চামড়াশিল্পে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কিছু ট্যানারি মালিকপক্ষের পিছু পিছু করার কারণে এ শিল্পের সদব্যবহার করা যাচ্ছে না। সম্ভাবনাময় এ শিল্পে অপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঘটছে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ। এ শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না হওয়ায় বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর আশেপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। দুষিত হচ্ছে মাটি ও বায়ু। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক ক্ষুদ্রশিল্পের কারখানাতে ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হয়ে বায়ু দূষণের

মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে। পৃথিবীর ২০ কোটি মানুষ প্রতিদিন সরাসরি পরিবেশ দূষণের ক্ষতি

মোকাবিলা করছেন। ভারী ধাতুর কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে আর ইলেকট্রনিক আবর্জনা জমছে নদীতে।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের ট্যানারিগুলো। সংখ্যার বিচারে কম করে হলেও ২২০টি ট্যানারি তো হবেই। আর এ সমস্ত ট্যানারিতে কাজ করেন অন্ততপক্ষে ২৫ হাজার শ্রমিক। ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহার করা হয় ক্রোমিয়াম, খার এবং অ্যাসিড। শ্রমিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া খালি পায়ে এবং খালি হাতে এই প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন। ফলে ক্যানসারও চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন তারা, যা তাদের অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। শুধু তাই নয়, এখানকার বর্জ্য আশেপাশের পরিবেশও দূষিত করে। ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা দূষিত করছে বুড়িগঙ্গার পানি, ট্যানারি এলাকার মাটি ও বায়ুকে। শ্রমিক ছাড়াও সে এলাকার বাসিন্দাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

শুধু ট্যানারি নয়, তাদের কেন্দ্র করে ছোট ছোট আরো অনেক অপরিকল্পিত কারখানা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। সেসব কারখানায় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য, যেমন টুকরো চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি, দাঁত এগুলো পুড়িয়ে পোলট্রি ফিডসহ আরো নানা জিনিস তৈরি করা হয়। এ সব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো এলাকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ট্যানারি এবং ওইসব ছোট ছোট কারখানার কারণে পুরো সে এলাকার মানুষ, মাটি, পানি এবং বাতাস এখন বিষে আক্রান্ত। আর এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গাও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। অথচ, জীবন ও পরিবেশের ক্ষতি করে। জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা গেছে, হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে দৈনিক ৭৭ লাখ লিটার তরল বর্জ্য ও ৮৮ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উদগত হয়। ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশের রাজধানী ও তার আশেপাশের জেলার নদীগুলোর দূষণমাত্রা চরমে। বলা যায়, শিল্পকারখানার বর্জ্য বা উপজাতসহ বিভিন্ন কারণে বড় শহরগুলোতে এ সমস্যা প্রকট। নদী হলো প্রকৃতির অন্যতম দান। নদীর প্রবাহ না থাকলে প্রকৃতিও বিরূপ হয়। অথচ নদীগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বুড়িগঙ্গা থেকে কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা থেকে সুরমা কিংবা তুরাগ থেকে রূপসাÑসব নদীই ভয়াবহ দূষণের শিকার। আমরাই আমাদের প্রকৃতির অন্যতম প্রাণ নদীকে হারিয়ে ফেলছি, নষ্ট করছি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতে দূষণের মাত্রা চরমে। যেখানে শিল্প, কলকারখানা যত বেশি সেখানে দূষণের মাত্রার অনুপাত ততই বেশি।

শিল্পকারখানা স্থাপনের সময় বা এখন শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কঠোর হতে হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলে কোনো শিল্প স্থাপনা করার অনুমোদন না দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অধিক কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিকসামগ্রী, পলিব্যাগ, চিপসসামগ্রীর মোড়কের ব্যপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এগুলো নদীদূষণের অন্যতম কারণ। নগরায়নে মাস্টার প্ল্যানের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পকারখানা বা আবাসিক স্থাপনা বা হাটবাজার স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু আইন করে বা আইন প্রয়োগ করেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সরকার, শিল্পপতি ও জনগণ-সবাইকে সচেতন হতে হবে। যার যার ক্ষেত্র থেকে আন্তরিক হলেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। আমরা চাই রাজধানীর নদী-খাল বর্জ্যমুক্ত হোক, দূষণমুক্ত হোক। এ জন্য দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। দরকার সচেতনতা। তাহলেই আগের রূপ ফিরে না পেলেও ভারসাম্য অন্তত রক্ষা হবে। এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close