অলিউর রহমান ফিরোজ

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

পর্যালোচনা

কৃষকদের ভর্তুকির নিশ্চয়তা

কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমদানিনির্ভরতা কমাতেই মূলত সরকারের এ সিদ্ধান্ত। ৮০ কোটি টাকার সার এবং বীজ কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। ৬ লাখ ৯০ হাজার ৯৭০ জন ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকের মাঝে এ সার ও বীজ বিতরণ করা হবে। ১১টি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারে এ প্রণোদনা ব্যবস্থা। তার মধ্যে ৬৫ হাজার ৭০০ জনকে গমবীজ, ২ লাখ ২১ হাজার ৫০০ জনকে ভুট্টা, ২ লাখ ১০ হাজার ২০০ জনকে সরিষা, ১০ হাজার ১০০ জনকে চীনা বাদাম, ১৮ হাজার জনকে গ্রীষ্মকালীন তিল, ৪৮ হাজার ৪০০ জনকে গ্রীষ্মকালীন মুগ, ২৪ হাজার ৩০০ জনকে শীতকালীন মুগ, ১৩ হাজার ৬০০ জনকে খেসারি, ৫ হাজার ৪০০ জন ফেলন, ২ হাজার ৭০ জন বিটি বেগুন এবং ৭১ হাজার ৭০০ জন পাবেন বোরো বীজ। প্রতিটি কৃষক পরিবার সর্বোচ্চ ১ বিঘা জমির জন্য বিনামূল্যে সার ও বীজ পাবেন।

প্রণোদনার অর্থ কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ থেকে দেওয়া হবে বলে সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ পড়বে না। তবে সমস্যা একটা জায়গায় রয়েছে, তা হলো দেশে প্রকৃত কৃষকদের কোনো কৃষি কার্ড নেই। তাই সঠিক এবং প্রকৃত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করাটাই হবে বড় ধরনের জটিলতার কাজ। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ অনেকটাই ধূলিসাৎ হয়ে যায় অনিয়মের কারণে। দেখা যাবে, যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত নয়, তাদের নামই আগে ভর্তুকির তালিকায় উঠে গেছে। আবার দেখা যাবে অকে কৃষকের ১ বিঘা জমি নেই, তাদেরও দেওয়া হবে সে পরিমাণ বীজ ও সার। তাই অনিয়মের আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে আমাদের প্রয়োজন প্রকৃত কৃষকের কৃষি কার্ড। এ কার্ডধারীদের জমির বিবরণ যেমন থাকবে, তেমন থাকবে তার জমিতে কী কী ফসল উৎপাদন হয়। এখন দেখা যাবে, একজন কৃষক চাষ করে গম তাকে দেওয়া হবে ভুট্টা বীজ আবার যে চাষ করে গম তাকে দেওয়া হবে মুগ ডাল। আবার যার জমি রয়েছে ১০ শতাংশ, তাকে দেওয়া হবে ১ বিঘা জমির বীজ ও সার। যে আবার কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই, সে-ও এ ক্ষেত্রে বনে যাবেন একজন কৃষক। তাছাড়া দেশের সরকার কৃষি খাতে বড় ধরনের ঋণদান কার্যক্রম হাতে নেয় প্রতিবছরই। কিন্তু তাতে কৃষকদের কোনো ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তার কারণ, দেশে কৃষকের কোনো সঠিক তালিকা নেই। তাই কৃষককে, কৃষিঋণ দেওয়ার আগে তাদের তালিকা তৈরি করে কার্ডের আওতায়ও নিতে হবে। তার কারণ হলো, ঋণদান পদ্ধতিতে বড় ধরনের গলদ থাকায় তা ব্যাংক এবং কৃষক উভয়ই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তার প্রধান কারণ হলো, দেশে কৃষকের সঠিক কোনো তালিকা না থাকা। তার ফলশ্রুতিতে প্রকৃত কৃষকরা সব সময়ই কৃষিঋণ থেকে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন ফসলের ওপর ঋণদান কার্যক্রম হাতে নেয়। তবে বিশেষ করে কিছু ঋণ আছে আবার ভর্তুকি পর্যায়ের। কিছু ঋণ আছে আবার বাণিজ্যিক। ফসলের ঋণ কৃষক ফসল ঘরে তুললেই পরিশোধ করতে হয়। আর বাণিজ্যিক ঋণ প্রথাগত নিয়মেই বিতরণ করে থাকে ব্যাংকগুলো। তবে ভর্তুকিঋণের হিসাবটা অবশ্যই আলাদা। দেশের স্বার্থে সরকার প্রতি বছর বিশেষ কিছু ফসলের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ করে থাকে। তার মধ্যে মসলা, ডাল এবং দুগ্ধজাত গাভীর জন্য এ ঋণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এবার আসা যাক, কৃষক কি সরাসরি তার ঋণটি পেয়ে থাকেন? একজন কৃষককে ঋণ পেতে হলে অনেকগুলো মাধ্যম ঘুরে আসতে হয়। গ্রামের নেতাগোছের কিছু লোক তখন দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে কৃষক যে ঋণ পেয়ে থাকেন, তার সিংহভাগই তাদের পেটে ঢুকে যায়। আবার অনেক সময় কৃষক সরল মনে, কৃষকের ছবি এবং তার জমির দলিল, পর্চা দালালের হাতে তুলে দেন। তখন কৃষকের অগোচরেই দালালরা কাক্সিক্ষত ঋণ তুলে নেন। এ ক্ষেত্রে কৃষক কিছুই জানতে পারছেন না। শুধু জানতে পারেন, যখন তার নামে ব্যাংক থেকে নোটিস যায় তখন। এ সময়ও থাকে দালালের কারসাজি। কৃষিঋণের একটা বড় ধরনের গলদ হলো তামাদি ঋণ। একজন কৃষক যদি ফসলের ওপর নেওয়া কৃষিঋণ তিন বছরের মধ্যে পরিশোধ না করেন, তবে তা তামাদিতে পরিণত হয়। একজন নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী কৃষক এবং তামাদি কৃষকের মধ্যে পার্থক্যে অনেক। ব্যাংকব্যবস্থা পদ্ধতিতে কৃষকের ঋণ তিন বছর অতিক্রম করে গেলে তার জন্য ব্যাংক কোনো ধরনের সুদ আরোপ করতে পারবে না। আর যিনি নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন, এ ক্ষেত্রে তার জন্য আছে আইনের যত প্রয়োগ। তার মানে খেলাপি হলে সেটার আর সুদ হবে না। তাহলে যে কৃষক একবার ঋণ নিয়ে তিন বছর পর্যন্ত ঋণের টাকা পরিশোধ করলেন না, তিনি ব্যাংকের আইন থেকে রেহাই পেয়ে গেলেন। কী আশ্চর্যজনক ঋণদান পদ্ধতি এবং নিয়মকানুন!

অন্যদিকে যেখানে ছোট ছোট মৎস্য খাত, হাঁস-মুরগি পালন কিছু বন্ধকী ঋণ রয়েছে, তা যদি ৫০ হাজার বা এক লাখ হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সম্পত্তি নিলামের জন্য ডাকতে পারে না। তাই দীর্ঘদিনে কৃষকের সে ঋণগুলো সুদে সুদে পাহাড় হয়ে জমে ওঠে; যা পরে একজন মৎস্য খামারি বা মুরগি পালনকারীর পক্ষে পরিশোধ করাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবেই দেশের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের টাকা সরকার যে কারণে ঋণ বিতরণ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরছেন তার প্রতিফলন ঘটে না। সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিঋণ হলো ভর্তুকীকৃত ঋণ। এ ঋণে ব্যাপক অনিয়ম ঘটায় সরকার তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য করতে পারছে না। বিশেষ করে, যারা দেশে মরিচ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, হলুদ, সরিষার আবাদ করেন, তাদের জন্য মাত্র ৪ শতাংশ সুদে দেওয়া হয় ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত। কিন্তু কোনো ব্যাংকই প্রকৃত কোনো কৃষককে উপরোক্ত ফসলের চাষের আওতায় আনতে পারেনি। এ ঋণ ব্যাংকের দালাল ও গ্রামের নেতা গোছের কিছু লোক বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে কৃষকদের দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে কৃষি ব্যাংকে এ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা সব সময়ই বেশি থাকে। সেখানে এ ঋণ নিয়ে কৃষক ঘর তোলেন, মেয়ে বিয়ে দেন বা অন্য কোনো কাজে ব্যয় করে থাকেন। তাই তো দেশের মধ্যে যদি পাশের দেশ ভারত আদা, রসুন, পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেন, তখনই আমাদের দেশে বিপত্তি ঘটে। পেঁয়াজের ঝাঁজে তখন চোখ দিয়ে পানি আসে সাধারণ মানুষের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক তদারকির অভাবে সরকারের বড় ধরনের প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য নস্যাৎ হয়ে পড়ে।

সরকার একটি বাড়ি একটি খামার গড়ার উদ্দেশ্যে বকনা গরু লালন-পালনে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পদক্ষেপ। এ খাতে কৃষককে বকনা গরু লালন-পালনে মাত্র ৫ শতাংশ হারে ঋণদান কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। কিন্তু গ্রামেও এখন দুধের কেজি ৬০ টাকা। তাহলে কি কৃষিঋণ বন্ধ থাকবে? না। এ ক্ষেত্রে আগে করতে হবে দেশের কৃষকদের কৃষিকার্ড। নগদ টাকা বিতরণে থাকে বড় ধরনের অনিয়ম এবং জালিয়াতি। অনেক ব্যাংক ম্যানেজারই নামে-বেনামে ভর্তুকীকৃত টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখছেন। তাতে করে অনিয়মের জালে বিরাট একটা জনগোষ্ঠী জড়িয়ে পড়ছে। সরকার প্রতি বছর যে টাকা দিয়ে বেশি মূল্যে খাদ্যশস্য আমদানি করে, সে টাকা যদি কৃষিকার্ড করে কৃষকদের অনুদান হিসেবে দেয়, তাহলে দেশের মূল্যস্ফীতি আর থাকবে না। সে সুফল পাবে পুরো দেশের মানুষ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close