রহিম আবদুর রহিম

  ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

পর্যালোচনা

শিক্ষা, কর্ম এবং বেকারত্ব

‘প্রাথমিক সংস্কৃতি উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাদের এক প্রচারপত্রে উল্লেখ করেছেন, ‘সংকীর্ণ চিন্তার লোকেরা পরনিন্দা-পরচর্চায় সময় ব্যয় করে, সাধারণ চিন্তার লোকেরা প্রতিদিনকার ঘটনার বিশ্লেষণ করেন। মহৎ চিন্তার লোকেরা সমস্যার সমাধানের উপায় খোঁজেন, শ্রেষ্ঠ চিন্তার লোকেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।’ প্রশ্ন, আমাদের শিক্ষা কোন চিন্তার অন্তর্ভুক্ত এবং কোনটি হওয়া উচিত?

শিক্ষা মানুষের সব দৈন্যদশা, অভাব-অনটন থেকে মুক্ত করারই কথা। অথচ, আমাদের দিন দিন দৈন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা সমস্যা সম্ভাবনা বিচার বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণালব্ধ মানবসম্পদ উন্নয়নের শিক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে চালু হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই। সম্প্রতি জাকির হোসেন বাচ্চু নামক জাপান প্রবাসী এক ব্যক্তি, তার জাপানের শিক্ষা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “জাপানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আগে ‘নীতি’ পরে ‘শিক্ষা’।” এই আদর্শ মেনে কমপক্ষে শিশুর ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা সেখানে নেই। আদর্শটি এমন যে, স্কুলজীবনে প্রথম তিন বছর মেধা যাচাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়নতা শেখানো হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভদ্র জাতি হিসেবে জাপানীরা যে খ্যাতি অর্জন করেছে, তা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থারই প্রতিফলন। এই জাপানে কোনো স্কুলেই ঝাড়–দার থাকে না। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা মিলে প্রতিষ্ঠান আঙিনা, স্ব স্ব বাড়ি পরিষ্কার করেন। বছরে একদিন ক্লিনিং ডে হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। তিনি তার অভিজ্ঞতায় বলেছেন, (জবধফরহম ভড়ৎ ঢ়ষবধংঁৎব) ‘আনন্দের জন্য পড়াশোনা’ কী জিনিস, সেটা জাপানেই রয়েছে । আমার ছেলেটি স্কুলে যাওয়ার যে ব্যাকুলতা তা দেখেছি জাপানেই।’ তার এই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের শিশুশিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কতটুকু মিল রয়েছে? আমরা কি সে ধরনের গবেষণালব্ধ শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি?

জাপানে একজন অভিভাবক তার সন্তানের স্কুলের পাঠদান ভিজিট করতে পারেন। শ্রেণিকক্ষের শেষ সারিতে অভিভাবক ভিজিটরদের বসার নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। আমাদের দেশে ভিজিট তো দূরের কথা, অভিভাবক ক্লাস চলাকালে শ্রেণিকক্ষের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেন না। এ যেন ১৪৪ ধারা জারি করা একটি নিষিদ্ধ অঞ্চল। মজার বিষয়, প্রতিটি পিরিয়ডে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা অনুযায়ী ক্লাস থেকে বের হতে পারে, রাস্তায় গিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল, আইন সম্পর্কে জানতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে ‘ফরমাল’ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। কোয়ালিটি এডুকেশনকে গ্রহণ করার জন্য একজন শিক্ষার্থী পারিপার্শ্বিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও অনেকাংশে দায়ী।

জাপানে মূল্যায়নের তিনটি মানদ- ঊীপবষষবহঃ (চমৎকার), এড়ড়ফ (ভালো), ঘববফ সড়ৎব রসঢ়ৎড়াবসবহঃ (আরো অধিক উন্নতির প্রয়োজন)। বাংলাদেশের এক সময়কার ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন পরিবর্তন হয়ে মানদন্ড প্রসব হয়েছে জিপিএ। এর ভেতর কী আছে, তা জিপিএপ্রাপ্ত প্রার্থী নিজেই জানে না। অথচ এ বি সি বা জিপিএ গোল্ডেন নামক আজব হরিণ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে সুস্থ শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণীরা মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধি হয়ে পড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল ‘শিশুদের বিকাশে নজর চাই’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘দুরন্ত ও বেপরোয়া শিশুদের আমরা অনেকসময় শাস্তি দিই। মনে রাখা জরুরি, শারীরিক শাস্তি শিশুকে আরো বেশি মারমুখী ও বেপরোয়া করে তুলতে পারে। যিনি শাস্তি দিচ্ছেন, তার প্রতিও নেগেটিভ অ্যাটিচ্যুড বীজ রোপিত হয়ে যেতে পারে। আরো মনে রাখা জরুরি, যারা শৈশবে নির্যাতনের শিকার হয় ভায়োলেন্সের কারণে দৈনিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা ভোগ করে, তারাই আবার নির্যাতনকারী হয়ে উঠতে পারে। এসব কারণে সমস্যা প্রতিরোধে সামাজিক স্তর থেকে শিশুদের হতাশা দূর করতে হবে। অথচ, আমাদের শিশুরা বাবা-মায়ের ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারই হওয়ার ইচ্ছাটি পূরণ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পড়ে চরম হতাশায় ভুগছে। এই হতাশা ওই শিশুটিকে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জাপানে ইলিমেন্টারি স্কুলে প্রত্যেক ক্লাসেই একজন শিক্ষকই সব বিষয়ে পাঠদান করান, তবে মিউজিক ও শরীরচর্চা শিক্ষক আলাদা থাকেন। তাদের এই পদ্ধতি চালু রাখার কারণ একটি, শিক্ষক যাতে শিক্ষার্থীর নাড়ি-নক্ষত্র জানতে পারে। বাংলাদেশে এমন একজন শিক্ষক আছেন, যিনি তার শিক্ষার্থীর নাম-ধামসহ পুরোপুরি ব্যক্তিগত তথ্য দিতে পারবেন? পারবেন না। কারণ, আমাদের পদ্ধতিতেই গলদ। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা হলফ করে বলছি না। জাপানে একটি ক্লাসে ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকে। শিক্ষক সংকট নিরসনে ওই দেশের ভলান্টিয়ার শিক্ষক রয়েছেন। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সম্মানির বিনিময়ে ব্যবহার করতে পারেন। অথচ, আমাদের দেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষকই নেই। কর্মক্ষম জাতি গঠন এবং হতাশাগ্রস্ত প্রজন্মকে উদ্ধার করতে হলে চাই গবেষণালব্ধ শিক্ষা পদ্ধতি বা ব্যবস্থা। শিক্ষা ও শিক্ষক দিবসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মো. মনিরুল ইসলাম তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘শিক্ষকদের সাধনা অন্য ১০টি চাকরির মত নয় নিঃসন্দেহে। শিক্ষকতা মানেই হলো সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া সামাজিক সংস্কৃতির দেশে শিক্ষাসেবায় দীনতা, অক্ষমতা, অমর্যাদা প্রকট সমস্যায় রয়েছে।’ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সম্প্রতি তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন দরিদ্র; যারা আমাদের ধনী করে গেছেন। এখন শিক্ষকরা ধনী শিক্ষার্থীরা গরিব হচ্ছে।’ অর্থাৎ শিক্ষা সেবকরা সব নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে শিক্ষাবাণিজ্যের বলয়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে।

যে দেশে শিক্ষা পদ্ধতি বা ব্যবস্থায় ‘অমেরুদ-’ নীতি, সেই দেশে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড; এই বাণী শুধু কথার কথাই। বিশ্বের বাণিজ্যিক মোড়ল হিসেবে পরিচিত চীনের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা সবাই জানেন, যে দেশের মানুষ একসময় তাদের মাতৃভাষা গুছিয়ে বলতে পারতেন না, তাদের আজ কী অবস্থা। দীর্ঘ ৬৫ বছর চীন মানবসম্পদ উন্নয়নে এক তরফাভাবে কারিগরি এবং পৈতৃক পেশাগত কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করেছেন। ওই দেশটি পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য দীর্ঘ পাঁচ বছর তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছিল। তৎকালীন চীন সরকারের ধারণা, এত ছেলেমেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী করবে? কোথায় চাকরি পাবে? কে তাদের চাকরি দেবে? ওই সময় থেকেই চীনের ছাত্রছাত্রীদের নানা ধরনের ট্রেড কোর্সে আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চীনের প্রতিটি বাড়ি একটি ফ্যাক্টরি। প্রতিটি পরিবারের প্রতিজন সদস্য এক একজন ইঞ্জিনিয়ার। অথচ, উজ্জ্বল সম্ভাবনার বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বাহারি নামের বিশ্ববিদ্যালয়। স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও বাংলাদেশে প্রায় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইভেট, যেখানে নেই ক্যাম্পাস, চার দেয়ালের ঝুপড়িতেই দেওয়া হচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা মন্ত্র। চীন যেখানে মানবসম্পদ উন্নয়নের কারখানা হিসেবে শিক্ষাকে গ্রহণ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনায় একটি দেশে বেকার তৈরির কারখানা প্রতিনিয়তই গড়ে উঠছে। বিবিএসের শ্রমশক্তির জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে বেকার ৪ কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে ২৬ লাখই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। বাকিরা অলস, অদক্ষ এবং মৌসুমি বেকার। জাপান এবং চীনের শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জাতি গঠনে গতানুগতিক শিক্ষা পরিহার করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুদক্ষ জাতি গঠনে শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা যায়, তবেই বাংলাদেশ অতি দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ববাজারে একতরফাভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। এ ক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণ নয়Ñকর্ম এবং কর্মী সৃষ্টির জন্য গবেষণালব্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close