এস এম মুকুল
বিশ্লেষণ
প্রোটিনের অন্যতম উৎস ডিম
মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনে এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে এই পোলল্ট্রিশিল্প। প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলো ডিম। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, চর্বি একেবারে খাওয়া ভালো নয়, কথাটা সঠিক নয়। যা ভালো নয়, তা হলো সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্সফ্যাট। গরু-খাসির মাংসের জমাট চর্বি, ঘি, মাখন, ক্রিম, পেসট্রি ও ডিপ ফ্রাই খাবারে আছে এ ধরনের ক্ষতিকর চর্বি। বাদ দিতে হলে এগুলো বাদ দিন। আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানে কেবল অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ দেওয়া নয়। আমরা জানি, প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ডিম অন্যতম। ডিমে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড; যা হৃদরোগসহ অনেক রোগের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। সাধারণ হিসেবে ১০০ গ্রাম খাসির মাংস থেকে যে প্রোটিন পাওয়া যায়, সেই একই পরিমাণ প্রোটিন মেলে ৪টি ডিম থেকে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, নারীদের অ্যাডোলেশন পিরিয়ডে বা পরবর্তীকালে কমপক্ষে ছয়টি ডিম খেলে ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা প্রায় ৪৪ ভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা ডিমকে একটি ‘পরিপূর্ণ খাদ্য’ বা কমপ্লিট ফুড বা সুপার ফুড হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ডিমের মতো এত স্বল্পমূল্যের প্রাণিজ আমিষ দ্বিতীয়টি নেই। মা, শিশু, যুবক ও বৃদ্ধÑ সব বয়সী মানুষের জন্য ডিম একটি আদর্শ খাদ্য। আমরা জানি, পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা রাতকানা, রক্তস্বল্পতা, হাড্ডিসার হয়ে যাওয়া ইত্যাদি রোগে ভোগে। তাই মেধাবী জাতি গড়তে হলে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ মাংস ও আমিষের জোগানদাতা হিসেবেও অবদান রাখছে পোলট্রিশিল্প। ভুট্টা ও সয়াবিনের সমন্বয়ে অর্গ্যানিক পদ্ধতিতে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে এ শিল্পের খাবার। ফলে আমিষের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনও। নতুন আশা নিয়ে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদনের পোলট্রিশিল্প সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি ডিম ও প্রায় ৪ হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। তার মানে অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদান ও ভূমিকা ব্যাপকতর হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রিশিল্প সমন্বয় কমিটির (বিপিআইসিসি) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ডিমের যে চাহিদা তা অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। আশার খবর হলো, এই শিল্পের উদ্যোক্তারা আবারও পোলট্রি পণ্য রফতানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডিমের খোসার ওপর সূক্ষ্ম কারুকার্য করা কিংবা ঘর সাজাতে ডিমের খোসার ব্যবহার শুরু হচ্ছে।
এ খাত সংশ্লিষ্টদের নিরবিচ্ছিন্ন ভূমিকার ফলে দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদাপূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে। ফলে দেখা দেখা দিয়েছে রফতানির সম্ভাবনাও। জানা গেছে, ২০০৫ সালের আগেও দেশের চাহিদা মিটিয়ে ডিম বিদেশে রফতানি হতো। কিন্তু ২০০৭ ও ২০০৯ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ায় পোলট্রিশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। বার্ড ফ্লু আঘাত হানায় ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ওআইই) শর্তের কারণে পোলট্রির রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ধকল কাটিয়ে আবারও বাংলাদেশ থেকে ডিম রফতানির স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদন হয় প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। আমরা যদি গড়ে ৭ টাকা করে একটি ডিমের দাম ধরি, তাহলে ডিমকে কেন্দ্র করে দৈনিক ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং মাসে ৮০৯ কোটি এবং বছরে ৯ হাজার ৭০৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার ছোট-বড় খামারে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ। আগে হ্যাচিং ডিম আমদানি করতে হতো। এখন বাংলাদেশে ৭টি গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ফার্ম আছে। প্যারেন্টস্টক বা পিএস ফার্মের সংখ্যা ছোট-বড় মিলে প্রায় ৮০টি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই দেশের হ্যাচিং ডিমের শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হতো প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। বছরে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬৩৯ কোটি। মাথাপিছু খাওয়া হতো প্রায় ৪১টি। ২০১৫ সালে ডিম দিনে উৎপাদন হতো প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ। বছরে উৎপাদন ছিল প্রায় ৭১২ কোটি। মাথাপিছু খাওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫টি। ২০১৬ সালে দিনে উৎপাদন হয় প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৮২১ কোটি। বর্তমানে মাথাপিছু খাওয়া হয় প্রায় ৫১টি। এই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে দৈনিক উৎপাদন হবে প্রায় ৪ কোটি ৫ লাখ ডিম। আর তখন মাথাপিছু কনজাম্পশন প্রায় ৮৬টিতে।
বিপিআইসিসি সূত্রে জানা গেছে, আগে হ্যাচিং ডিম আমদানি করতে হতো। এখন বাংলাদেশে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ফার্ম আছে। প্যারেন্টস্টক বা পিএস ফার্মের সংখ্যা ছোট-বড় মিলে প্রায় ৮০টি। আশার খবর হচ্ছে এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই দেশের হ্যাচিং ডিমের শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে সপ্তাহে এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি ডিম ফোটানো হয়। মুরগি পালনের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খাবার ও পানি সরবরাহ, ডিম সংগ্রহ সবকিছু স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা হয়। ফলে ভোক্তারা সহজেই স্বাস্থ্যকর, জীবাণুমুক্ত ডিম ও মুরগির মাংস পাচ্ছেন।
পোলট্রিশিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে ছয়টি পোলট্রি ফার্ম স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও ১৯৮০ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে পোলট্রিশিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। গত তিন দশকে তা দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প খাতে রূপ নিয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, সুস্থ থাকার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে মাত্র ৪৫-৫০টি। তবে আশার খবর হলো, ডিম শুধুমাত্র পুষ্টি উপাদেয় খাবার হিসেবে অসুখ অসুস্থতায় অথবা অতিথি আপ্যায়নে নয়, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ডিমের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। পিতা-মাতারা সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য প্রতিদিনি ডিম খেতে দিচ্ছেন। নিজেদের সুস্থতায় সকালের নাস্তায় ডিম খাচ্ছেন অনেকে। ডিনারে বা লাঞ্চেও ডিমের মুখরোচক রন্ধনশৈলী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বয়স্ক ও সন্তানসম্ভবা মায়েদেরও ডিম খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে দেশের মানুষের মাঝে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। সন্তানের স্কুল টিফিনে ডিম দিয়ে তৈরি রকমারি নাস্তা প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে সরকারের স্কুল ফিডিংয়ে ডিম অন্তর্ভুক্ত করলে ডিমের ব্যবহার ও চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এবিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ করতে পারে।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
"