আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

শ্রমিক ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তবে কিছু কিছু কারণে টানাপড়েন চলছে এ শিল্পে। ব্যবসা ও শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ, মজুরি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, এ শিল্পের আধুনিকায়ন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু নীতি গ্রহণ করতে হবে বা যুগোপযোগী করতে হবে। বিদ্যুৎ-তেল-জ্বালানির জন্য ‘জ্বালানি নীতি’ গ্রহণ করা যেতে পারে। তাহলে বিপুল সম্ভাবনাময় এ শিল্প থেকে আমরা আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাব, অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। পরোক্ষ হিসাবে অন্য সেক্টরের গতি আনবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাব। পোশাকশিল্প, পর্যটনশিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পগুলোতে গতি আনতে পারলে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেবে।

২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী-ট্যানারি শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা, জাহাজভাঙা শিল্পে ১৬ হাজার এবং ওষুধশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা। সেখানে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা পান মাত্র ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অথচ, আমরা জানি তৈরি পোশাকশিল্প অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করছে এবং রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ অর্জন করছে। তাই এ শিল্পের শ্রমিকদের সবচেয়ে কম মজুরি পাওয়ার হিসাবটি সুখের নয়।

শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রথমে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা দাবি করেছিল, পরে তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। সর্বশেষ তারা ১২ হাজার টাকা নির্ধারণের কথা বলেছে। গত পাঁচ বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৩২ শতাংশ। সেই হিসাবেও ন্যূনতম মজুরি আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত। অক্সফামের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে একজন সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৫৫ ডলার, ভিয়েতনামে ১০০ ডলার, ভারতে ৭৮ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ডলার ও পাকিস্তানে ৯৯ ডলার। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশে শ্রমিক পান মাত্র ৬৮ ডলার।

কাক্সিক্ষত ফল পেতে হলে সরকার, মালিক ও শ্রমিকÑতিন পক্ষকেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। শ্রমিকের ঘামের মূল্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম। তাই উৎপাদন খরচ অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম হয়। সরকার আন্তরিক হলেও মালিকপক্ষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকের বেতন নির্ধারণে আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ। কিন্তু গোপন কক্ষে উৎপাদন খরচ ও আয়ের হিসাব করে শুধুমাত্র মানবিক কারণ উপলব্ধি করে মালিকপক্ষ সদয় হলে শ্রমিকপক্ষকে সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন কাজ নয়। বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বা দেশের অন্য অনেক সেক্টরের তুলনায় এ খাতের শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করা খুব সহজ। কারণ, তাদের দাবি খুব বেশি নয়। তবে শ্রমিকরা যাতে ইচ্ছাকৃত বিশৃঙ্খলা না করতে পারে, এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। আগে তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় শতকরা ৮০ ভাগের মতো। ক্রমান্বয়ে এ হার কমতে শুরু করেছে। এটা হতাশাজনক। কারণ পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিকের মূল্য অনেক কম। পথে পথে হয়রানি, শ্রমমূল্য অনেক কম, নিরাপত্তাজনিত ও অন্যান্য কারণে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ ও আয়ের হিসাবের অনুপাত কমে যাচ্ছে; যা এ শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। সম্ভাবনাময় এ খাতের দুর্গতি শুরু হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গত বছর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশ্ববাজারে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। তৈরি পোশাক খাতের ছোট পর্যায়ের কাজের অর্ডার বাড়ার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। এ সুযোগ সমানভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তানের সামনেও। তিনি বলেন, ক্রেতা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশে তার ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া, সম্ভাব্য ভালো ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতেও আমরা দুর্বল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম

বন্দরের বিভিন্ন অদক্ষতার কারণে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। যেসব বিনিয়োগকারী চীন ছেড়ে যাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এখন একটি কৌশল থাকা প্রয়োজন মনে করেন তিনি।

‘স্টিচেস টু রিচেস: দক্ষিণ এশিয়ায় পোশাক খাতে কর্মসংস্থান, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের গত বছরের এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনে পোশাক খাতের পেছনে এক শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি এ পণ্য রফতানির সুযোগ বাড়বে এক দশমিক ৩৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চীনে শতকরা ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য নতুন করে আরো চার দশমিক ২২ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ র‌্যাংকিং অনুযায়ী ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েছে আছে। বিশ্ব বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা ২০১৭ অনুসারে, বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের বাজারে বাংলাদেশের অংশ বাড়ছে। ২০১৫ সালের পাঁচ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন তা ছয় দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে, চীনের শেয়ার পড়তির দিকে। ২০১৫ সালে যা ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল, তা কমে এখন ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।

চীনের ছেড়ে দেওয়া বা পড়তি বাজারে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। এ জন্য দরকার বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ। দেশের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, চীনের পোশাকশিল্পের বাজার দখল করতে হলে বাংলাদেশকে প্রথমেই যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে, তা হলো বিশ্ববাজারে এখন কোন পণ্যের চাহিদা বেশি, তা খুঁজে বের করা এবং এসব পণ্যের ক্রেতা কারা, সেটি নির্ধারণ করা। বিদেশি বাজার ধরতে হলে ও চীনের পড়তি অংশ লুফে নিতে হলে পোশাকের মান বাড়াতে হবে। সরবরাহের সময় কমাতে হবে। সরবারহের দীর্ঘ সময়ের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা চীন বা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দক্ষদের বেশি বেতন দিতে হবে। তাহলে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। শিল্পকারখানার ভৌত অবকাঠামো মান উন্নত করতে হবে। বন্দর ব্যবস্থায় উন্নয়ন করতে হবে। পোশাকশিল্পের জন্য বন্দরে আলাদা সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। শ্রমিকের নিরাপত্তা অন্যান্য বিষয় নিশ্চিত করে শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব করতে হবে। পোশাকের

মান নিয়ন্ত্রণ, সময় কম, ভৌত অবকাঠামো শক্তিশালী করা ও শ্রুমিকের বেতন বৃদ্ধি করে শৃঙ্খলায় কঠোরতা আনয়ন করে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে, আমাদের দেশের ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ তার পূর্বের গৌরব ফিরে পাবে এবং বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গতি পাবে।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close