সফিউল্লাহ আনসারী

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন

ডিজিটাল সময়ের দাপট চলছে বিশ্বজুড়ে। সেই হাওয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার আর ডিজিটাল সামগ্রীর সহজলভ্যতা আমাদের জীবনকে গতি দিয়েছে। দিয়েছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে ডাক যোগাযোগ ছিল অন্যতম। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে এই জনপ্রিয় ও একমাত্র যোগাযোগমাধ্যমটি। দেশ-বিদেশে যোগাযোগ, টাকা ও পণ্য পাঠাতে কাজ করত এই ডাক বিভাগ। এখনো কাজ করছে, তবে তা একেবারেই মন্থর গতিতে।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডাকযোগে চিঠিপত্র আদান-প্রদান ছাড়া চিন্তা করা যেত না। ইদানীং ই-মেইল-ইন্টারনেটের যুগে সেই ডাক বিভাগের গুরুত্ব আর রানারের চিঠি বিলির ব্যস্ততা খুব একটা নেই। যদিও এখনো আমাদের দেশের বিভিন্ন অফিস আদালতের ফাইল-পত্রাদির আদান-প্রদান ডাক মারফত করা হয়। হলুদ খামের চিঠি, পোস্ট অফিস ও ঐতিহ্যের প্রতীক ডাকবাক্স এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। যা-ও দু-একটা দেখা যায় জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে যতœহীন। অফিসগুলো ভেঙেচুরে ময়লা পড়ে হারাচ্ছে তার জৌলুস। প্রশ্ন জাগে, তবে কি হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম এই যোগাযোগমাধ্যমটি?

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের জীবন এবং কর্ম ক্রমেই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে সময়, শ্রুম এবং অর্থ বাঁচলেও কিছু কিছু বিষয়ের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের প্রজন্মকে যান্ত্রিক জীবনের স্বাদ দিয়ে আন্তরিকতা মায়া-মমতাকে অনেকাংশে তুচ্ছ করছে। মনে হচ্ছে, আমরা ক্রমেই যান্ত্রিক সভ্যতার টানে প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি অপব্যবহারের দিকেই যাচ্ছি। আমরা ইচ্ছে করলে আমাদের অতীত ঐহিহ্যের ব্যবহার কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারি। হাতের কাছে ইন্টারনেট, ইমেইল, ফেসবুক ও টুইটারসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপটে এখন আর হাতে লেখা চিঠি কেউ পাঠায় না। আর প্রাপকও অপেক্ষা করেন না তার প্রিয়জনের চিঠির জন্য। মোবাইল ফোনও এই চিঠি না লেখার জন্য অন্যতম কারণ। মোবাইলে এসএমএস ও হ্যালোতেই বন্দি আজ চিঠির প্রয়োজনীয়তা।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার বিখ্যাত রানার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে/ দস্যুর ভয়, তারও চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।’ ‘রানার! গ্রামের রানার! /সময় হয়েছে নতুন খবর আনার; শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ, ভীরুতা পিছনে ফেলে/পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, অগ্রগতির মেলে,/দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি, নেই, দেরি নেই আর,/ ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে/দুর্দম, হে রানার ॥’

অথচ, আজ আর রানার বা ডাকবাক্স নিয়ে কোনো কবিতা লেখা হয় না। নেই কোনো মাতামাতিও। ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠি, জরুরি প্রয়োজনে টেলিগ্রাম আর স্বজনদের পাঠানো কোনো জিনিস এখন আর প্রতিক্ষাকে দীর্ঘায়িত করে না। কারণ, একটি ইমেইল যা মূলত চিঠিই, তা প্রাপকের কাছে পৌঁছতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট। আর পণ্যের বাহক কুরিয়ার সার্ভিস ২৪ ঘণ্টায় পৌঁছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। প্রযুক্তির দাপটে

একসময়ের অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম আজ আমাদের অবহেলা আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে

হারাচ্ছে তার অতীত ঐতিহ্য ও সুনাম। ডাকঘরগুলোর বেহাল দশা, জরাজীর্ণ স্থাপনা, ডাক বাক্সের অযতœ মøান করেছে ডাক শব্দটির গুরুত্ব।

সময়ের সঙ্গে বর্তমানে এই ডাকঘরেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। দেশের অনেক ডাকঘর এখন আধুনিক সব সরঞ্জামে ভরপুর ডিজিটাল অফিস। পোস্ট অফিস এখন ইন্টারনেট অফিস। কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টার দিয়ে সাজানো ডাকঘর এখন সত্যিকারের পোস্ট অফিস। এক নিমিষেই চিঠির আদান-প্রদান হয় দেশ-বিদেশ। সব আজ হাতের কাছে। অথচ, যেন প্রাণহীন। ঐতিহ্যের অংশ এই ডাকঘরের কেন এই অবস্থা? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হয়, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, জনগণের অনাগ্রহ ইত্যাদি। জানা গেছে, প্রতি বছরই লোকসানের মুখে পড়ে ডাক বিভাগ। একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান আজ ক্ষতির সম্মুখীন, সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি, লুটপাট আর পরিকল্পনাহীনতায় ।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ডাক বিভাগকে এখনো জনপ্রিয় করা যায়। অথচ, তা হচ্ছে না। একই কাজ নিয়ে দেশে একাধিক ডাক মাধ্যম, যা কুরিয়ার সার্ভিস নামে জমজমাট ব্যবসার পাশাপাশি জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। একসময় টাকা পাঠাতেও ব্যবহার হতো পোস্ট অফিস। মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হলেও এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা আরো দ্রুত ও কার্যকর হওয়ায় পোস্ট অফিসমুখীতাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে এখন মানুষের ভিড়। বিশ্বস্থতা আর সঠিক সেবার কারণে বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে যাচ্ছে আর আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠান পোস্ট অফিসগুলো দিনে দিনে হারাচ্ছে তার জৌলুস। ক্ষতি আর লোকসানে দুর্বলতার দিকে এগোচ্ছে দিন দিন।

ইতোমধ্যে ডাক বিভাগে ডিজিটালের ছোঁয়া লাগলেও, দক্ষ জনবল আর প্রচারের অভাবে এই বিভাগের বিভিন্ন সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বেশির ভাগ ডাকঘরের অবস্থা অত্যন্ত বেহাল-করুণ দশা। গ্রামাঞ্চলের ডাকঘর গুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। আমার জানামতে, গ্রামাঞ্চলের অনেক ডাকঘরের নেই নিজস্ব কোনো ভবন। আর ভবন না থাকায় মূল্যবান ডিজিটাল সামগ্রী রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুত সংযোগসহ নানা জটিলতায় এসব দামি পণ্যগুলো নষ্ট হচ্ছে অযতœ অবহেলায়। অনেক জায়গায় ঘর ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও জনবলের অভাবে ভাঙাচোরা আসবাবপত্র নিয়ে খোলামেলা পরিবেশে ডাকঘরের কার্যক্রম আগ্রহ কমাচ্ছে ব্যবহারকারীর। অনেকটা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পোস্ট অফিসগুলো। পোস্ট মাস্টারদের নিজস্ব ঘরে সংরক্ষিত থাকছে সরকারি ও পাবলিকের মূল্যবান ডকুমেন্টস। সরকারের উচিত পোস্ট অফিসগুলো সময়োপযোগী করে তুলতে নিজস্ব ভবন নির্মাণের দিকে দ্রুত নজর দেওয়া।

‘১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ডাক বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট ৯ হাজার ৮৮৬টি পোস্ট অফিস রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) রয়েছে ৪টি।’ ‘সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী সারা দেশে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাধারণ চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে ৫ কোটি আর ২০১৪-১৫ সালে হয়েছে ৪ কোটি। আর রেজিস্টার চিঠির আদান-প্রদান হয়েছে প্রায় ৭ কোটি।’ এতেই অনুমেয় পোস্ট অফিসের এ অবস্থায় এই বিভাগ কতটা লোকসানে।

এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার একটাই উপায়, সঠিক এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনা, ডিজিটাল সামগ্রীর ব্যবহার, প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজস্ব পাকা ভবন নির্মাণ, বিদ্যুৎহীন এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা, দ্রুত চিঠির আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করাসহ (যেমন কুরিয়ার সার্ভিসগুলো করে থাকে) প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। মোটকথা, বর্তমান বাস্তবতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে ডাক বিভাগের উত্তরণ ঘটানো দরকার। সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট মাস্টারদের (ইউনিয়ন পর্যায়ে) বেতন-ভাতার পরিমাণ যুগোপযোগী করাও সময়ের দাবি। হয়তো হারানো ঐতিহ্য আর পুরনো সেই

সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close