আতিক সিদ্দিকী

  ১১ অক্টোবর, ২০১৮

নিবন্ধ

এলেন ঘোটকে যাবেন পালকিতে

দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের মধ্য দিয়ে গত সোমবার শুরু হয়েেেছ শারদীয় দুর্গোৎসবের সব আনুষ্ঠানিকতা। এবার পঞ্জিকা অনুযায়ী দেবী দুর্গা এসেছেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চড়ে আর যাবেন দোলায় বা পালকিতে চেপে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে ভারতের অনেক প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে থাকে। কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা বা অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা বা রুদ্রাণী, কান্যকুব্জে কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে দেবী দুর্গার পূজা-অর্চনা ও উৎসব হয়ে থাকে। দেবী দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। তিনি আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। দুর্গতিনাশিনী বা দুর্গম মহিষাসুর নামের দৈত্যকে বধ করেন বলে তার নাম হয় দুর্গা এবং মহিষমর্দিনী। আবার জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাকে দুর্গা বলা হয়। ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়েছিল। বিষ্ণুর নির্দেশে সব দেবতার তেজপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই তেজদীপ্ত দেবী মা দুর্গা। সব দেব-দেবীর শক্তিতে শক্তিময়ী এবং বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এ দেবী যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেছিল। তাই দেবীর অনেক নামের মধ্যে আরো একটি নাম হয় মহিষমর্দিনী। কালিকাপুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, দুর্গোৎসববিবেক এসব গ্রন্থে দেবী দুর্গা সম্পর্কে এভাবেই বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে। দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে পুরাণে লেখা রয়েছে যে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তারা দেবী দুর্গার পূজা করেন। এ সময় পূজায় তুষ্ট দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এ পূজা সে সময় বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর অপর এক নাম ‘বাসন্তী’ পূজা।

দুর্গাপূজা তিনভাবে হয়ে থাকতে পারে সাত্ত্বিকভাবে জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দ্বারা পূজা পালন করা যেতে পারে। তামসিকভাবে কিরাতদের জন্য বিহিত; এতে জপ, যজ্ঞ ও মন্ত্র নেই; মদ্যপান, মাংস প্রভৃতি দ্বারা পূজা করা হয়ে থাকে ও রাজসিকভাবে পশুবলি ও আমিষ ভোগ দ্বারা পূজা করা হয়। অতীতে দুর্গাপূজার সময় ছাগ, মেষ, মহিষ, হরিণ, শুঁকর, গন্ডার, ব্যাঘ্র, গোসাপ, কচ্ছপ বা পাখি বলি দেওয়া হতো। কোনো কোনো গ্রন্থে নরবলির বিধানও ছিল। বর্তমানে অবশ্য এসব বলির আর প্রচলন নেই বললেই চলে। দেবী সাধারণত দশভুজা, তবে শাস্ত্রানুসারে তার বাহুর সংখ্যা হতে পারে চার, আট, দশ, ষোলো, আঠারো বা কুড়ি। প্রতিমার রং হতে পারে অতসীপুষ্পবর্ণ বা তপ্তকাঞ্চনবর্ণ। কখনো বা রক্তবর্ণা। প্রতিমা ছাড়াও পূজা হতে পারে দর্পণে, অনাবৃত ভূমিতে, পুস্তুকে, চিত্রে, ত্রিশূলে, শরে, খড়গে বা জলে। চন্দনকাঠের দুর্গা মূর্তি, যেটি মুর্শিদাবাদ থেকে প্রাপ্ত। বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতায় রক্ষিত আছে দুর্গাপূজায় হিন্দুদের সব বর্ণের লোকেরাই অংশগ্রহণ করতে পারে।

বলা হয়ে থাকে যে, সম্রাট আকবরের (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫) রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০ থেকে ১৭৮৩) সময়ে বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন।। কিন্তু জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০ থেকে ১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪ থেকে ১৪৬০) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫ থেকে ১৪৬০) দুর্গোৎসবিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১ থেকে ১৪৬১) রামায়ণ, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫ থেকে ১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, রঘুনন্দনের (১৫০০ থেকে ১৬০০ শতক) তিথিতত্ব ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় ধারণা করা হয় যে, বাংলায় দুর্গাপূজা দশম অথবা একাদশ শতকেই প্রচলিত ছিল। হতে পারে কংসনারায়ণ কিংবা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে তা জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। উনিশ শতক থেকে কলকাতাতেও মহা ধুমধামের সঙ্ড়ে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়ানরাও দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণ করত।

ঢাকার সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এ ছাড়া শতাধিক মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। কলাবাগান, বনানী এবং গুলশানেও পূজা হয় জাঁকজমকপূণভাবে। রমনার পূজা হয় ভিন্ন আমেজে। পুজার কয়েক দিন বেশ জমিয়ে আড্ডা বসে সেখানে। ঢাকা মহানগরীতে এবার ২৩৪টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পূজা উপলক্ষে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশন-মন্দিরে অষ্টমীর দিন আট-দশ বছরের একটি বালিকাকে দুর্গা সাজিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। দশমীর দিন সরকারি ছুটি থাকে। এ বছর দশমীর দিন শুক্রবার হওয়ায় বড় এই উৎসবে কেউই আর ছুটি ভোগ করতে পারবে না। যদিও হিন্দু সম্প্রদয়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ছুটি বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের নজরে আনার চেষ্টা করে চলেছেন। দশমীর দিন সকাল থেকে চলে বিসর্জনের আয়োজন। মিছিল সহকারে প্রতিমা নিয়ে বিকেল থেকে শুরু হয় নিকটস্থ নদী-খাল-বিল কিংবা পুকুরে বিসর্জনের আয়োজন। ঢাকার অধিকাংশ প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গায়। এভাবে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পাঁচ দিনব্যাপী মহাদুর্গোৎসব।

মর্ত্যে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা শুরু হয়েছে এবার গত সোমবার থেকে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজা ও ভক্তির মাধ্যমে দুর্গাপূজার ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে সোমবার। দেবী দুর্গার আগমনী বন্দনার এই আয়োজনকে বলা হয় মহালয়া। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরুর ছয়দিন আগে হয় এই মহালয়া। রাজধানীর বিভিন্ন পূজামন্ডপে সোমবার ভোর থেকেই পূজা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। এদিন সকাল ৬টায় চ-ীপাঠ, ভক্তিমূলক গান ও নাচের মধ্য দিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠান শুরু হয়। দুপুর ১২টায় দেবীর আবাহনের জন্য মূল পূজা, অর্থাৎ ‘ঘট স্থাপন’ হয়। রাজধানীর বনানীতেও সকালে মহালয়ার আয়োজন করা হয়। মহালয়ার পর থেকে ১৫ দিন হচ্ছে দেবীপক্ষ। মহালয়ায় দেবী দুর্গার আবাহন ছাড়াও পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তিকামনা করে শ্রদ্ধা জানানো হয়, যাকে তর্পণ বলে অভিহিত করা হয়।’ শারদীয় দুর্গা উৎসবকে অকালবোধনও বলা হয়। অকালবোধন সম্পর্কে জানা যায়, রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি মহাউৎসব। দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই প্রচলিত। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে।

দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালসহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি ভারতের অসম, বিহার, ঝাড়খন্ড, মণিপুর এবং ওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথামাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা ও নবরাত্রি উৎসব পালন করে। এমনকি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও এ দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন।

বাংলাদেশে বিজয়াদশমীতে সর্বসাধারণের জন্য একদিন সরকারি ছুটি থাকে। মূলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম গানটি রচনা করেন যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন সমাজের অনাচার দূর করতে অত্যাচারী মহিষাসুর ও তার দল বলকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতেই ত্রিশক্তি দুর্গা দেবীর আত্মপ্রকাশের চিন্তা করলেন। দেবী দুর্গা আবার একাকী নন। তিনি অন্যান্যদের নিয়ে যেমন ধন (লক্ষ্মী), শিক্ষা (স্বরস্বতী), কার্তিক (যোদ্ধা), গনেশ (সিদ্ধিদাতা), সবাইকে নিয়ে মহিষাসুর বধে ব্রতী হন।

লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ, ঐশ্বর্য এবং পার্থিব সব পঙ্কিলতা ত্যাগ করলেই শুধু মাত্র ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া যায়, এটাই মাহভারতের শিক্ষা। মনুষত্বকে পুনরুজ্জীবিত করে সব অন্যায় ও জুলুমকে বিতাড়িত করা এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে ন্যায় পথে থেকে প্রতিরোধ গড়াই ধর্মীয় শিক্ষা। এ বিষয় সব ধর্ম গ্রন্থই প্রায় একই সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অপরূপ বাণী প্রচার করে চলেছে। আজও দুর্গাপূজার মধ্য দিয়ে সেই শিক্ষাই প্রচারিত হয়ে আসছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে অসুরদের অত্যাচারে, অত্যাচারে পৃথবিী যখন অতিষ্ট, দেবতারা যখন র্স্বগ থেকে বিতাড়িত, তখন অসহায় দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বররে স্মরণাপন্ন হন। এই ত্রিশক্তির সম্মিলিত তেজে এক নারী শক্তির উৎভব হয়। তিনি দেবী দুর্গা। দুর্গা বা নারী রূপে শক্তি কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, স্বর্গমর্ত্যরে এক ঈশ্বরের মত ক্ষমতা পেতে চায় মহিষাসুর। সে ব্রহ্মা বরে অমরত্ব লাভ করেছিল। তাকে কোন পুরুষ ধ্বংস করতে পারবে না। বলেছিলেন ব্রহ্মা। তাই মহিষাসুরকে বধ করতেই নারীরূপে দুর্গার আবির্ভাব ঘটেছিল।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close