আহমদ আবদুল্লাহ

  ১১ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইসলাম

আমাদের চারপাশে জীব ও জড়ের সমন্বয়ে গঠিত যা কিছু আছে, তা নিয়ে পরিবেশ। পরিবেশের মূল উপাদান হচ্ছে তিনটিÑ মাটি, পানি ও বায়ু। এ তিনটি মূল উপাদান বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জীবকে আশ্রয় ও আহার জুগিয়ে থাকে। পৃথিবীর সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন পদ্ধতি মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে এমন আঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে যে, এক প্রকার জীব বহু বিচিত্র পদ্ধতিতে অন্য প্রকার জীবকে সাহায্য করে থাকে এবং গ্রহণ করে। এর ফলে প্রতিটি প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভবপর হয়। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী তার কোনো শরিক নেই। তিনি সব বস্তু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে (সুরা ফুরকান : ৪)।

পরিবেশ আমাদের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আমাদের বেঁচে থাকার সব উপাদান আমরা পরিবেশ থেকে পাই। একই প্রাকৃতিক পরিবেশে যেসব জীব জন্মায় তাদের প্রত্যেকেরই স্বাতন্ত্র থাকে। এরকম বিভিন্ন জীবের সংখ্যা সমষ্টিকে জীব-সম্প্রদায় বলা হয়। একেক অঞ্চলের জলবায়ু সে অঞ্চলের উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে এবং প্রাণীরাও সেখানকার উদ্ভিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এভাবে একেক অঞ্চলের জড় পরিবেশ ও জীব সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেঁচে থাকার জন্য এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশম-লী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন’ (সুরা জাসিয়া : ১৩)।

একটি নির্মল ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালার গুরুত্ব সর্বাধিক। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা হলোÑ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাপোকরণ ও চিকিৎসা। এর সবকটি সরবরাহ হয়ে থাকে বৃক্ষকুল থেকে। গাছ সমগ্র প্রাণীকুলের জীবন রক্ষাদানে উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এরপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য কর, যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য কর। নিশ্চয় এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্য (সুরা আনআম : ৯৯)।

মহান রাব্বুল আল-আমিন মানুষের কল্যাণের জন্যই যাবতীয় পশু-পাখি সৃষ্টি করেছেন। আমরা এগুলো থেকে দুধ, গোস্ত, চামড়া, পশম, মালামাল বহনের প্রয়োজনে, অর্থনৈতিক, চাষাবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপকার পেয়ে থাকি। মহামহিম আল্লাহ বলেন, ‘গবাদিপশুর মধ্যে কিছু ভারবাহী ও কিছু ক্ষুদ্রকায় পশু সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তোমাদের যা রিজিকরূপে দিয়েছেন, তা হতে আহার করো, (সুরা আনআম :১৪২)। কিছু পশুর পশম দ্বারা আমরা বস্ত্র ও শীত বস্ত্র তৈরি করে থাকি এবং হাড় ও দাঁত দ্বারা অনেক ব্যবহার্য জিনিস তৈরি করি। কোরআনের এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারণ উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে এবং তা হতে তোমরা আহার করে থাকে (সুরা নাহল : ৫)।

পৃথিবীর তিন ভাগেই পানি দ্বারা বেষ্টিত। পৃথিবীতে সমুদ্রের মোট আয়তন ৩৬১ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। এটি পৃথিবীর জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ গ্রহে প্রতি বছর গাছপালার মাধ্যমে যে পরিমাণ বিশুদ্ধ অক্সিজেন বায়ুতে মিশে তার সত্তর শতাংশই আসে সামুদ্রিক উদ্ভিদ থেকে। সমুদ্রই মানুষের জন্য জলজ সম্পদের ভা-ার। সমুদ্রের পানি বায়ুতে ভেসে আল্লাহর করুণার মেঘ হয়ে এসে বৃষ্টিরূপে পতিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণা সিক্ত হয়ে নব জীবন লাভ করে। প্রকৃতির প্রতিটি গাছপালা ফুলে ফলে ভরে ওঠে। সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে ফসলের মাঠ। পানির অপর নাম জীবন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রতিটি মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি’ (সুরা আম্বিয়া : ৩০)। আজ পানির উৎস ভা-ার সমুদ্রই নানাভাবে দূষণের শিকার। সব প্রকার বর্জ্য আবর্জনা এবং পারমাণবিক পরীক্ষা শেষ স্থল সাগর-মহাসাগর। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন টন বর্জ্য ও বিভিন্ন প্রকার আবর্জনা সাগরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে জাহাজ ও টেংকার হতে নিষ্কাশিত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। নার্ভ গ্যাস, বড় ও মাঝারি আকারের পাট, কাগজ, ম-, টেক্সটাইল, সার, প্লাস্টিক, ট্যানারি, খাদ্য ও পানীয়, চিনি, তামাক, এলকোহলজাতীয় শিল্প-কারখানা হতে নির্গত তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ সরাসরি এবং মৃত্তিকা হতে নিঃসরিত হয়ে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এসব বিষাক্ত বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রে প্রতিনিয়ত নিক্ষিপের ফলে সামুদ্রিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এতে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও মৎস্যকুলের অস্তিত্ব বিপর্যয় হতে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে উদ্ভুত বিষাক্ত বায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। সুতরাং, সেদিকে আমাদের দিতে হবে সজাগ দৃষ্টি। পরিবেশ দূষণ, সামুদ্রিক দূষণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এদিকে সামুদ্রিক মাছে রয়েছে বহু উপকারিতা, আছে মানু্ষরে প্রয়োজনীয় উপকরণ চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দুইবার মাছ খান তাদের, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোস্ত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলঙ্কারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে, তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১৪)।

পরিশেষে বলব, আমরা পরিবেশকে বাঁচানো এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসি, পরিবেশ সংরক্ষণের জ্ঞানার্জন করি এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হই তবেই সুন্দর সবল সুস্থ দেহে বসবাস করতে পারব। পরিবেশ হবে আমাদের অনুকূলে। সুগঠিত সমাজ পাব, পাব নয়নাভিরাম মুগ্ধকর পরিবেশ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close