সাধন সরকার

  ১০ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

বদলে যাবে দেশ

বায়ুমন্ডলে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু উন্নয়নশীল ও গরিব দেশে নয়, উন্নত দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। আবার বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ (ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে)। প্রতি বছর বন্যা, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরাসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার মানবসৃষ্ট নানা করণে প্রাকৃতিক পানিচক্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগতে হচ্ছে পৃথিবীর ছোট্ট এ ব-দ্বীপকে। তথ্যমতে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ষষ্ঠ। উন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। হঠাৎ অতিবৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে বন্যা। উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততা। আবার বহু বছর ধরে নদীভাঙনের মতো সমস্যার টেকসই কোনো সমাধান বের করা যায়নি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জীবন-জীবিকা বহুলাংশে নদীনির্ভর। কিন্তু প্রকৃতি-পরিবেশবিনাশী কর্মকা-, দখল-দূষণ আর মানুষের অসচেতনতার কারণে বহু নদ-নদী ইতোমধ্যে মরে গেছে। অনেক নদ-নদী ধুঁকছে। ভারতের সঙ্গে অভিন্নপ্রায় ৫৪টি নদ-নদী থাকলে কোনো কোনো নদ-নদীর পানির নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ভারতের হাতে! প্রয়োজনের সময় ভারতের নদ-নদীগুলো পথকে পানি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে গ্রীষ্মে একদিকে বাংলাদেশে খরা দেখা দেয়, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত তাদের সুবিধার্থে বাংলাদেশে পানি ঠেলে দেয়, ফলে দেখা দেয় বন্যা! এ যেন এক অমোঘ নিয়তি! জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এসব সমস্যা মোকাবিলা না করে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারছে না। উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। তাই এ বাস্তবতায় গ্রহণ করা হয়েছে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনা, যা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে পরিচিত।

বর্তমান বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়; তারই পরিকল্পনা এই ‘ডেল্টা প্ল্যান’। আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বপ্ন মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একসময় যে পদ্মা সেতুর স্বúœ ছিল, বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের তা আজ দৃশ্যমান। বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার এমনই এক স্বপ্নময় পরিকল্পনা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’। সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলাসহ পানিব্যবস্থাপনা, কৃষি, মৎস্য, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প, বনায়ন, টেকসই নদী ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় রেখে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় নদীশাসন, নদীভাঙন রোধ, নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সার্বিক পানি ব্যবস্থাপনা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে। প্রথম পর্যায়ে এই ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়’ ছয়টি এলাকায় (হটস্পট) ৮০টির মতো পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পানিসম্পদকেন্দ্রিক ১০০ বছরের এই উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রথম পর্যায়ে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করা ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন করা। নেদারল্যান্ডসের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে এ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসও একটি ব-দ্বীপ। বলতে গেলে, সমুদ্র জলতটের নিচে তার অবস্থান। নেদারল্যান্ডসকে পুরো ফোল্ডার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। অনুরূপ পরিকল্পনায় এ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডস ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশও নদীবাহিত পলি দিয়ে এমনভাবে ভূমি পেতে পারে! পৃথিবীর সভ্যতাগুলো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। নদী না বাঁচলে সভ্যতাও বাঁচবে না! তাই বলা হচ্ছে, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশও বাঁচবে না! দুঃখের বিষয়, নদীকে আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করছি, নদীপথকে শুধু নিয়েই যাচ্ছি। নদী থেকে নিতে নিতে প্রকৃতির প্রাণ নদীগুলোকে সুযোগ বুঝে আবার ধ্বংসও করে ফেলছি! নদ-নদী আমাদের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। নদ-নদীকে টিকিয়ে রেখে তার সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করা যায়, তাহলে নদীগুলো টিকে থাকবে। এ জন্য সামগ্রিক সমন্বিত ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়’ নদ-নদীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। বলা হচ্ছে, এই ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন হলে প্রবৃদ্ধি দেড় শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা একটি দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। এখনো বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য উন্নত বিশ্বের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে! ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি দুর্যোগ রোধে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আর খরচ হবে না। প্রতি বছর দুর্যোগে জানমাল রক্ষা পাবে। নদ-নদী বাঁচবে। জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হবে। এক কথায় ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়’ বদলে যাবে বাংলাদেশ। এখন যেটা দরকার, সেটা হলো এই পরিকল্পনার পরিকল্পিত ও টেকসই বাস্তবায়ন। বাস্তবায়নকালে এলাকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় অধিবাসীর অভিজ্ঞতা ও জনজীবনকে গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close