মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ০৯ অক্টোবর, ২০১৮

নিবন্ধ

আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী

শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণ, এরূপ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্ক। দাতা গ্রহীতার সম্পর্কের চেয়ে অনেক পবিত্র এ সম্পর্ক। শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কেবলই জ্ঞান লাভ করে না, তার উপদেশ ও পরামর্শ থেকে পায় জীবন ও চরিত্র গঠনের মূল্যবান নির্দেশনা। শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চাইলে তার প্রতি শিক্ষার্থীকে হতে হবে শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত, থাকতে হবে তার ওপর গভীর আস্থা। আর তখনই শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে সর্বোত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে সাধিত হবে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হবে সুন্দর পরিবেশ। শিক্ষার্থীর দুর্বিনীত আচরণ শিক্ষককে নিদারুণ হতাশায় ভরে তুলে, বিনিময় শিক্ষার্থী কিছুই লাভ করে না। অবাধ্য ও দুর্বিনীত শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে পারে না কিছুই, তার অর্জন কেবলই শূন্য।

শিক্ষক মহৎ সেবা দানে নিয়োজিত। তার এ সেবা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যেমনি যায় না মা-বাবার সেবা সন্তানের প্রতি। মা-বাবা সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন আর শিক্ষক তাকে শিক্ষিত করেন। তার হৃদয়-মনকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন, তাকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সে সম্পর্ক তা সব হীনস্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে দেখতে চান জ্ঞানের আলো, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এবং পরিচ্ছন্ন ও সচেতন মন। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক আশা করেন, সদাচারণ ও সৎস্বভাব। শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শিক্ষক আনন্দিত হন। বিপথগামী হতে দেখে ব্যথিত হন। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের যে ব্যাকুলতা, তা না পাওয়ার হতাশা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়ার বেদনা, শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত না হওয়া বেদনা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার বেদনা।

শিক্ষার্থীর মধ্যে যুগ যুগ বেঁচে থাকেন শিক্ষক। শিক্ষকের জ্ঞান ও দর্শন, শিক্ষা ও জীবনবোধ তার অজান্তে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রোথিত হয়। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কোনো কোনো শিক্ষার্থী তার প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণা করে। এ প্রিয় শিক্ষকই তার জীবনকে নাড়া দিয়েছে বিরাট করে, প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে। সৎ এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষকই কেবল শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করতে এবং জীবন ও চরিত্র গঠনে তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। আর এমন শিক্ষকই জাতির কাম্য, সবার কাছে সম্মানীয়। যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে কোনো আদর্শ ও মূল্যবোধ উপস্থাপন ও তা লালনে সক্ষম নন, তিনি কখনোই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। নীতি ও নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষক কখনো শিক্ষার্থীর আদর্শ ও প্রিয় শিক্ষক হতে পারেন না। কেননা, তিনি শিক্ষার্থীকে যথাযথ শিক্ষিত ও চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন।

মা-বাবা তার সন্তানকে শাসন করেন। সেটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বাভাবিক ও কাম্য হলো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে শাসন করা। শিক্ষার্থীকে আজকাল শাসন করা যায় না, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। তা ঠিক নয়। শিক্ষার্থী যথার্থ ক্ষেত্রে, যথাসময়ে তার শিক্ষকের যথার্থ নির্দেশনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ প্রত্যাশা করে ও পছন্দ করে। যতই দুর্বিনীত হোক না কেন। শিক্ষকের যথার্থ যুক্তি ও ন্যায়বোধের কাছে সে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। পরিবেশ ও প্রতিরোধ তা ক্ষণিকের জন্য বিলম্বিত করে মাত্র। শিক্ষার্থীরা বয়সে তরুণ, স্বভাবে চঞ্চল ও চিন্তায় বিপ্লবী। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রবিশেষে নেতৃত্ব দিতে চায়, কিছু একটা করতে চায়, সবার কাছে তার কৃতিত্ব তুলে ধরতে চায়। যথাযথ পথনির্দেশের অভাবে তারা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়, হয় বিপথগামী। তাদের মধ্যে নেতৃত্ব গ্রহণের ও সমস্যা সমাধানের কিছু প্রতিভা হয়তো আছে। এ সত্য উপলব্ধি করে তাদের প্রতিভা ও কার্যস্পৃহাকে যথাযথ খাতে চালিত করে তাদের মধ্যে যথার্থ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেন। বিজ্ঞজনরা বলেন, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’।

শিক্ষকদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকরা সমাজের প্রত্যাশা যত পূরণ করতে পারবেন, সমাজও তত সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। শিক্ষকরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। তাদের শিক্ষার আলো শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে। তাই মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন বিপুলসংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। ন্যায়সংগত এবং গুণগত শিক্ষা অর্জনে শিক্ষকরা হলেন চালিকাশক্তি। এ জন্যই শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শিক্ষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষকসমাজ এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই সচেতন মহল মনে করে। শিক্ষকের পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা ও বেতন কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয়করণ, দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার অভাবের কারণে শিক্ষকসমাজ সমাজের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। সমাজ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষকসমাজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাবৈষম্য দূর করতে হবে, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে। মেধাবী, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। মূল্যবোধভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। যারা শিক্ষকতায় আসবেন, তাদের শিক্ষকতা পেশাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকদের সমাজ ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে নিজের আদর্শ স্থাপন করতে হবে। কেননা মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান। প্রবীণ দক্ষ শিক্ষকরা বিদায় নিচ্ছেন। এসব শূন্যস্থান পূরণে সব রকম অনৈতিকতা পরিহার করে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। শিক্ষকতায় মেধাবীদের না আসা এবং এলেও বেশি দিন না থাকার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। তাই আজ বেশি প্রয়োজন শিক্ষার সব স্তরে উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আগমন। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাসহ শিক্ষার উন্নয়নে আধুনিক ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ সময়ের দাবি। এখন প্রয়োজন পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, পেশাগত স্বাধীনতা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা।

শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয় বরং এটি একটি আরাধনা। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। যথার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে দেশ আশা করতে পারে অসংখ্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত মানুষ। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে লুকিয়ে আছে প্রতিভা। সুপ্ত হয়ে আছে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। তারই যথার্থ বিকাশ ঘটাতে হবে। তাকে উত্তম চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানানুশীলনে শিক্ষার্থীর আন্তরিক প্রচেষ্টা। কর্তব্য পালনে শিক্ষকের নিষ্ঠা ও সততা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সুসমন্বিত বিকাশ। শিক্ষার্থীকে সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে যেমনি গড়ে তুলতে হবে, শিক্ষা সমাপনের সঙ্গে সঙ্গে তেমনি উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগও থাকতে হবে বিস্তৃত ও অবারিত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close