মোতাহার হোসেন

  ০৮ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

বাংলাদেশের কৃষিতে বিস্ময়কর সাফল্য

সরকারের নানামুখী উদ্যোগ, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ফসলের বহুমুখীকরণ, কৃষকের সচেতনতা, সময়মতো বীজ, সার ও কীটনাশকের সহজলভ্যতায় কৃষিতে রীতিমতো বিপ্লব হয়েছে। এখন দেশের প্রায় সর্বত্র বছরে তিন-চার ফসলের আবাদ হচ্ছে। গ্রামে যারা কৃষিকাজে জড়িত, তারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক পরিশ্রমী, কর্মঠ এবং ফসলের রোগবালাই দমনে অধিকমাত্রায় সচেতন। একসময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশ, এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। খাদ্যসহ নানা ধরনের শাকসবজি রফতানি করে দেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে জলবায়ুসহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের কারণে। ৯ বছর ধরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে, ভরে উঠেছে শস্যভা-ার। অথচ আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও মানুষ বছরে এক ফসল আবাদ করত। এখন সময় বদলেছে, ফসলের নতুন নতুন বীজ উদ্ভাবনের কারণে বছরজুড়েই কৃষকরা জমিতে চাষাবাদ করছে। কৃষিতে এই পরিবর্তনে কৃষিবান্ধব সরকারেরও বিশাল অবদান রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, গত ৯ বছরের ব্যবধানে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ লাখ টন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন দেশের সাহসী ও পরিশ্রমী কৃষকদের। তবে সরকারের ফলপ্রসূ নীতি যেমন, চাষাবাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ সার, বীজ, কীটনাশক এবং কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান, সেচব্যবস্থা, কৃষি কার্ড বিতরণ, নিত্যনতুন উন্নত প্রযুক্তির জোগান দিয়ে যাওয়া, এমন সাফল্যের পেছনে বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে। কৃষি উপকরণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কৃষকদের মধ্যে প্রায় সোয়া দুই কোটি কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কার্যক্রমে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চাল, গম, ভুট্টা উৎপাদন ছিল প্রায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ টন, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮ অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই উৎপাদন ৪০৭.১৪ লাখ টনে পৌঁছায়। একইভাবে বেড়েছে ডাল, পেঁয়াজ ও পাটের উৎপাদন। উদ্ভাবিত হয়েছে নতুন নতুন জাতের বিভিন্ন ফসল।

ধারাবাহিক সাফল্যকে এগিয়ে নিতে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তাই কম জমিতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য টেকসই পদ্ধতি ব্যবহার করা প্রয়োজন। কৃষক আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন। কোন জাত নেবে, কী প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, কী ধরনের এবং কতটুকু সার-কীটনাশক দিতে হবে, তা এখন তারা নিজেরাই যাচাই ও প্রয়োগ করে থাকে। কৃষি সাংবাদিকতা গবেষক মিজানুর রহমান বলেন, দেশের সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষিসম্প্রসারণ বিভাগ কর্তৃক সফলভাবে উন্নত জাতের শস্যের বীজ ও চারা মাঠপর্যায়ে সময়মতো কৃষকদের মধ্যে পৌঁছানো এবং কৃষিক্ষেত্রে সরকারে বিভিন্ন উদ্যোগ এই সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছে। তিনি কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের ন্যায্যমূল্য যাতে নিশ্চিত করা হয় সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, কৃষকের উৎপাদিত শস্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামীণ হাট-বাজারে কৃষকদের নিয়ে গঠিত সমবায় সমিতির কাছ থেকে সরাসরি সরকারি উদ্যোগে শস্য ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাহলে এ পর্যায়ে মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল ও ফড়িয়াচক্র কৃষকদের ঠকাতে পারবে না। এতে কৃষক লাভবান হলে তারা কৃষিকাজে আরো বেশি মনোযোগী হবেন, যা দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে ৩৩টি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গবেষণা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ কাউন্সিল রূপকল্প ২০৩০ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি টিম গঠনের মাধ্যমে সারা দেশের মাঠপর্যায়ের গবেষণা কার্যক্রম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কর্মসূচি পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন করছে। বিটি বেগুনের চারটি জাত উদ্ভাবন, প্রতিকূল আবহাওয়া উপযোগী ধান ও গমের জাত উন্নয়নসহ পরিচর্যা কলাকৌশল নির্ধারণ করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বিতড়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া তাপসহিষ্ণু গমের জাত ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় বিতড়ন করা হয়েছে।

ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের বীজ। ভালো বীজ এককভাবে ফসলের ফলন ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিশেষ জাতের সুপার হাইব্র্রিড ধানের ৪৫৭ টন বীজ উৎপাদন ও ৬২৬.২৫ টন বোরো বীজ কৃষকপর্যায়ে সরবরাহ করেছে। বিএসডিসি সারা দেশে ২৪টি দানা শস্যবীজ উৎপাদন খামার, দুটি পাটবীজ উৎপাদন খামার, দুটি আলুবীজ উৎপাদন খামার, দুটি সবজিবীজ উৎপাদন খামার ও ১১১টি চুক্তিবদ্ধ চাষি জোনের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চলতি ২০১৭-১৮ মৌসুমে বিএডিসি মোট ১.৪৮ লাখ টন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১.২৮ লাখ টন বীজ কৃষকপর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে।

কৃষি সহায়ক হিসেবে সেচের জন্য ৫৮০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, দুটি রাবার ড্যাম নির্মাণ, ৫৫৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণ, ১১টি সৌরশক্তিচালিত সেচপাম্প স্থাপন, ১১.২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ৬১০টি শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, ১১৮টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ১৪৯টি গভীর নলকূপ পুনর্বাসন করা হয়েছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৭টি ফসলের ৩০টি জাত অবমুক্তকরণ ও ২২টি ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। দেশে গমের বাস্ট রোগ শনাক্ত হয়েছে। এ রোগের বিস্তাররোধে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রমের প্রক্রিয়া চলছে। অনুরূপভাবে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে ব্রি ধান ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৫, ৭৬ ও ৭৭ উদ্ভাবন এবং বোরো মৌসুমের জন্য ব্রি ধান ৭৪ উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার জন্য তিনটি লবণসহিষ্ণু সারির আঞ্চলিক উপযোগিতা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। কম মাত্রার প্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ধান ব্রি ধান ৪৬ ও ব্রি ধান ৬৯ চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় আরবীয় খেজুরগাছের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। চরাঞ্চলে উন্নত পদ্ধতিতে ইক্ষু উৎপাদন প্রযুক্তি, গুড় তৈরি ও ব্যবহারবিষয়ক চাষাবাদ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিএসআরআই ডমেস্টিক কেন ক্রাশার যন্ত্র, সুগারবিট রুট রুট রোগ দমন প্রযুক্তি, সুগারবিট ক্যাটারপিলার পোকা দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, সুগারবিটের প্রমিতকৃত কৃষিতাত্ত্বিক প্রযুক্তি, বিএসআরআই পাওয়ার উইডার যন্ত্রের সফল ব্যবহার করা হয়েছে।

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সার সুপারিশমালা ২০১৬-এর আওতায় আধাবিস্তারিত মৃত্তিকা জরিপের মাধ্যমে ৪৬০টি উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদকরণের জন্য ২০টি উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।

কৃষকদের আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্তকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশ কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংককে কৃষিঋণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি কৃষিঋণ বিতরণ সহজতর করে এবং নতুন নতুন বিষয় সন্নিবেশ করে বিগত অর্থবছরগুলোর মতো ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বর্ধিত কলেবরে কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ১৭৫৫০.০০ বিতরণ ২০৯৯৮.০০ ঋণ আদায় ১৮৮৪০.০০। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ ১৪৫২০.৪২ ঋণ আদায় ১৩৫৯৬.৯৯।

দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে লাভজনক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও জাতীয় কৃষিনীতিকে সামনে রেখে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের এ কাজে সহায়তা করছে দেশের অগণিত পরিশ্রমী কৃষক। উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে দেশ এগিয়ে যাবে টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকেÑএ বিশ্বাস, এই আস্থা এখন দেশের আপামর জনগণের।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close