রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে দুই কোরিয়া

কোরীয় উপদ্বীপে অবশেষে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে। ‘রকেটম্যান’ আখ্যা পাওয়া উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন পরমাণু যুদ্ধের হুমকি-ধমকি থেকে বের হয়ে শান্তির পথ খুঁজতে শুরু করেছেন। আসলে কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সা¤্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দুই ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি কম্পিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে।

গেল জুন মাসে সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর ১৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া সফরে যান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন। এ সফরে দুই কোরিয়া যে কটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী একটি শান্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্পর্কে পশ্চিমাবিশ্বে এক ধরনের ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল। কিম ক্ষ্যাপাটে, যুদ্ধবাজ বদরাগী, নিজের আত্মীয়স্বজনকে মেরে ফেলতে তিনি দ্বিধা করেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি এক ধরনের ‘ইমেজ’ সংকটে ভুগছিলেন। বলা হচ্ছিল, যেকোনো সময় তিনি কোরীয় উপদ্বীপে ‘যুুদ্ধ’ বাধিয়ে ফেলতে পারেন! কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার বৈঠক, উত্তর কোরিয়ার কয়েকটি পারমাণবিক উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়ে তিনি ‘শান্তির পক্ষে’ তার কমিটমেন্ট প্রকাশ করেছিলেন। এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেন। এ নিয়ে তিনি তিন-তিনবার দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার সঙ্গে মিলিত হলেন। দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের মধ্যকার বৈঠক শেষ অবধি কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি কতটুকু নিশ্চিত করবে, তা এ মুহূর্তে বলা না গেলেও, এটা বলাই যায়, একটা শুভসূচনা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা মুন জায়ে ইনের পিয়ং ইয়ং সফরের সময় উত্তর কোরিয়া দেশটির প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা স্থাপনা বন্ধ করে দিতে সম্মত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোরিয়া যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সিউল সফরে যেতে রাজি হয়েছেন।

শুধু তা-ই নয়, উত্তর কোরিয়ার নেতা উনের সঙ্গে বৈঠকের পর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া এক ধরনের নিরস্ত্রীকরণেই সম্মত হয়েছে। ২০৩২ সালে একসঙ্গে দুই কোরিয়া অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করবে বলেও তারা জানান। দুই কোরিয়ার মধ্যে এ ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি প্রশ্নকেই এখন সামনে নিয়ে এলো, আর তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার মধ্যে একত্রীকরণের সম্ভাবনা কতটুকু? দুই জার্মানি একত্র হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর। দুই কোরিয়া কি এখন সেদিকেই যাচ্ছে? এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইতানস্থ পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমাবিশ্বের ধারণা, উত্তর কোরিয়া ছয়টি থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়।

এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান ও সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলে ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। ১৯৯০ সালে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তার অভিজ্ঞতা কম। গেল বছরের শেষের দিকে উত্তর কোরিয়া একের পর এক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। একপর্যায়ে কিম গুয়ামে মার্কিনি স্থাপনার ওপর পারমাণবিক হামলারও হুমকি দিয়েছিলেন। সেই অবস্থান থেকে জুনে কিম যখন সিঙ্গাপুরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন, সেটা ছিল একটা উল্লেখ করার মতো ঘটনা। অনেক পর্যবেক্ষকই এটা বলার চেষ্টা করেছেন, উত্তর কোরিয়ার এ মনোভাব পরিবর্তনের ব্যাপারে চীনের একটা ভূমিকা ছিল। চীন হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতার উৎস। আন্তর্জাতিকভাবে উত্তর কোরিয়ার ওপর এখনো অর্থনৈতিক অবরোধ বজায় রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানির উৎস হচ্ছে চীন। উত্তর কোরিয়ায় প্রচ- জ্বালানি ও খাদ্য সংকট রয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় চীন উত্তর কোরিয়ার পাশে আছে। সুতরাং ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে কিম চীনে গিয়েছিলেন ‘পরামর্শ’ নিতে। এখন কিম দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাচ্ছেন, সেখানেও চীনের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্নটিকেও একপাশে ফেলে রাখা যাবে না। দক্ষিণ কোরিয়া তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে মার্কিনি ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। এ ক্ষেপণান্ত্র উত্তর কোরিয়া কর্তৃক নিক্ষেপিত যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্র মহাশূন্যে ধ্বংস করে দিতে পারবে। ফলে ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র আর দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো হামলা চালাতে পারবে না। ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে বসানো হলেও এর খরচ কে বহন করবে, এটা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের এক ধরনের মতানৈক্য চলে আসছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তি যেহেতু এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার স্বার্থে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং দক্ষিণ কোরিয়াকেই এ অর্থ বহন করতে হবে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার আপত্তি ছিল তাতে। তার পরও সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হয়েছে। এটা উত্তর কোরিয়ার ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ। ট্রাম্প-কিম বৈঠকের পর ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়নি।

কিন্তু কিম যখন কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, তখন তার উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হবে। দুই কোরিয়া পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের উত্তর কোরিয়া সফরের সময় তিনি কিম জং উনের সঙ্গে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। সংবাদ সম্মেলনে মুন জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া তাদের ইয়ংবিয়ানের পরমাণু ক্ষেত্র বন্ধ করে দিতে সম্মত হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেও যথাযথ সাড়া দিতে হবে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। দুই কোরিয়ার সব ভালো ভালো উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে তাদের মনোভাবের পরিবর্তন না করে। উত্তর কোরিয়ার নেতা দ্বিতীয়বারের মতো ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান। তার এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি ও খাদ্য সাহায্য দরকার। পশ্চিমা বিশ্বকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহারও জরুরি।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close