সাঈদ চৌধুরী

  ০৪ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

মা-বাবাও এক দিন...

ছোটবেলায় বাবার আঙুল ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে হলেই মনে পড়ে আমার বৃদ্ধ দাদার কথা। দাদা বৃদ্ধ অবস্থায় আমার বাবার সঙ্গে খুব বেশি ঘুরে বেড়াতে চাইতেন। দাদা প্রায়ই কথা বলতে শুরু করলে আর থামতেন না। বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কখনো কখনো একেবারে মধ্যরাত পর্যন্ত দাদা কথা বলেই যেতেন। স্মৃতিচারণা, সাংসারিক ও জীবনে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা-সবকিছুই থাকত এই আলাপচারিতার মধ্যে। আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হতো, বাবা সারারাত ধরে দাদার একই কথা শুনে যায়, তবুও কখনো বিরক্তি বোধ করে না! উত্তর পাওয়ার জন্য অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। দাদা এবং দাদু মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি শূন্যতা আর অনুভূতির কতটা গাঢ়ত্ব। বৃদ্ধকালে দাদা এবং দাদু দুজনই একেবারে শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন। যা-ই করতেন, সবকিছু বাবাকে জিজ্ঞেস করে করতেন। অনেক সময়ই দেখতাম, দাদার বিছানা বাবা থেকে ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন এবং আমার মা-ও সাহায্য করছেন। এতকিছুর পরও দাদা-দাদু প্রায়শই আলাপ করতেন এবং বলতেন সেই তারুণ্য ভরা জীবনের গল্পগুলো। একসময় একজনের মৃত্যুর পর যখন অন্যজন খুব বেশি একা হয়ে যান, তখন দেখলাম শিশু আচরণের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়।

ঠিক এই সময়টাতে প্রতিটি মানুষই একদিন আসে। কিন্তু প্রতিটি মানুষই কি আমার দাদা-দাদুর মতো সঙ্গ পায়? অনেক প্রতিষ্ঠিত পরিবারগুলোর এখন একক পরিবার হিসেবে থাকতে পছন্দ করছে। বাবা-মাকে তারা ঝামেলার মনে করে। একটি পরিবারে যেখানে সন্তান আছে কিন্তু বাবা-মা নেই- এ বিষয়টি যে অভাবের, তাড়নার তা যেন ভাববার মানুষই পৃথিবীতে এখন আর নেই। আরেক ধরনের পরিবার আছে, যারা বাবা-মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকলেও বাবা-মায়ের খবর রাখতে যেন খুব অমনোযোগী! তেমনি একটি বাস্তব গল্প বলি। আমাদের বাড়ির কাছের একজন মানুষ, যিনি সমাজে খুব বেশি প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতির সঙ্গেও খুব বেশি সংশ্লিষ্টতা তার। সে হিসেবে প্রতি ঈদে জাকাতের কাপড় নেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণ মানুষের সমাগম ঘটে তার বাড়িতে। শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে সবার মন জয় করে নেন খুব তাড়াতাড়িই। মানুষ দোয়া করে যায় আর তার মুখে দেখি অনাবিল হাসি! কিন্তু তার মা? বৃদ্ধাবস্থায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা প্রতিবন্ধী। একসময় একটি ছোট্ট ঘরে তার মাকে আমরা বেঁধে রাখতেও দেখেছি! কী সেই মর্মান্তিক দৃশ্য! চিৎকার করে কান্না আর অভিশাপের চরম হাহাকার দেখে হৃদয়ে দাগ কেটে যেত! প্রতিবেশীরা কিছু বললে তাদের ওপরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন তিনি।

একবার ভাবুন তো! যখন এই লোকটি খুব ছোট ছিলেন, তখন মা কীভাবে বড় করে তুলেছেন? আমার ছোট্ট বাচ্চাটির জন্য রাতে ঘুমোতে পারি না, তার আবদার রাখার জন্য মধ্যরাতে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে চাঁদ দেখাতে হয়, যখন হাঁটা শুরু করল একাধারে দু-ঘণ্টা ধরে তার হাতে ধরে ধরে হাঁটাতে হত, একটু মন খারাপ হলেই আমার কোলেই অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিয়েছে। আরো কত কী! এ রকম তো প্রতিটি শিশুই বাবা-মাকে ঘিরেই বেড়ে ওঠে। তারপর শিশুরা বড় হয় আর বাবা-মায়েরা হয়ে ওঠেন শিশু! যখন বাবা মায়েরা শিশু হয়ে ওঠেন, তখনই যেন ঘোর বিপত্তি। এই বিপত্তিগুলোই প্রবীণদের জীবনকে ঠেলে দেয় অসহায়ত্বের দিকে। বৃদ্ধাশ্রমে না গিয়েও বয়স্ক মানুষেরা অনেকেই আছেন ঘরে বন্দি হয়ে। দেখার কেউ নেই, কথা শোনার কেউ নেই, নেই মান অভিমানের কোনো পরিসমাপ্তির মানুষও ! আপনি যখন পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত, তখনই হয়তো আপনার বাবা-মা আপনার শিশু জীবনে ফিরতে শুরু করবে। এটাই চিরচারিত নিয়ম। আমাদের শিশু জীবনে আমরা যেমন বাবা মাকে ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখি তেমনি আমাদের বাবা-মায়েরাও আমাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সময় যেন আমরা পাশে থাকি। এটা দ্বায়ীত্ব এবং কর্তব্য।

আমার বাবা-দাদার সঙ্গে যে আচরণ করতেন তা আমার প্রায়ই মনে হয় আর আমি শুদ্ধ হই। এ কারণেই যৌথ পরিবার প্রথাও প্রয়োজন যাতে করে একজনকে দেখে অন্যজন অনুপ্রাণিত হয়। বয়স্ক মানুষ একটি বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে বসবাস করবে- এটাই আমাদের চাওয়া।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close