এস এম মুকুল
হৃদরোগ
সুস্থতার অন্যতম ঝুঁকি
হার্ট বা হৃদযন্ত্র হলো মানুষের প্রাণশক্তি। হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা জীবন ও সুস্থতার ক্ষেত্রে অন্যতম ঝুঁকি। তাই সবল হার্ট সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের জন্য আবশ্যক। আমরা সচেতনভাবেই শরীরের নানা বিষয়ে কিছুটা যত্নশীল হলেও হার্ট বা হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় অনেকটাই উদাসীন। অথচ, যার সঙ্গে জীবন-মরণের বিষয় জড়িত, সে বিষয় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলা বা অবজ্ঞা করে থাকি। অথচ, বলা হয়ে থাকে অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুঝুঁকির শীর্ষে হৃদরোগ। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ২০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত। আবার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ উচ্চরক্তচাপ, ১০ শতাংশ করোনারি হৃদরোগ, এক দশমিক দুই শতাংশ বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশেরও বেশি ঘটছে অসংক্রামক ব্যাধি হৃদরোগ থেকে (সূত্র : ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউট)।
হার্ট ভালো রাখতে কী করবেন : লবণ কম খান। ধূমপান এড়িয়ে চলুন। সুষম খাবার খান, প্রাণ খুলে হাসুন। ব্যায়াম করুন নিয়মিত। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যান, রক্তচাপ মাপুন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করুন। কর্মচঞ্চল থাকুন। ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। মদ্যপান বাদ দিন। সামাজিক কাজে বেশি যুক্ত হোন। প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান। হার্ট সুস্থ রাখতে এসব খাবার এড়িয়ে যাবেন-মগজ, ডিমের হলুদ অংশ, কলিজা (গরু বা খাসি), চিংড়ি, বিশেষ করে বড় চিংড়ি, আইসক্রিম, চকলেট, খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, গরুর মাংস, মুরগির চামড়া, দুধের সর খাবেন না বা যথা সম্ভব কম খাবেন।
সুস্থ হার্টের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার : হৃদরোগীদের স্বাস্থ্যকর খাবার তেলের মধ্য রয়েছে-সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, অলিভ অয়েল এবং যে তেলগুলো হৃদরোগীর জন্য ক্ষতিকর, সেগুলো হলো পামঅয়েল, নারিকেল তেল ও পাম কার্নেল। এ ছাড়া কোলেস্টেরল দুই রকম হয়। একটি হলো খউখ বা খারাপ এবং অন্যটি ঐউখ বা ভালো কোলেস্টেরল। রক্তে খউখ কোলেস্টেরলের মাত্রা ১০০ মিলি গ্রাম বা উখন্ড এর নিচে রাখতে হবে। আর যাদের ধমনিতে রিং লাগানো আছে বা বাইপাস করা আছে তাদের জন্য ধূমপান সর্বনাশা। ধূমপানে বাইপাস ও রিং হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সাধারণ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আর হঠাৎ রিং বন্ধ হয়ে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। শাকসবজিসহ সব ধরনের দেশি টাটকা ফল, সব রকম মাছ, বিশেষত সামুদ্রিক মাছ, সূর্যমুখীর তেল, জলপাইয়ের তেল ও মাছের তেল (পাম অয়েল এবং নারকেল তেল/দুধ ছাড়া)।
বুকে ব্যথা হলেই কি হার্ট অ্যাটাক : অনেকেরই ধারণা, বুকে ব্যথা মনেই হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকের একটি উপসর্গ হলো বুকে ব্যথা। তবে সব ধরনের বুকে ব্যথা মানেই হার্ট অ্যাটাক নয়। কারণ অন্য অনেক কারণেও বুকে ব্যথা হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা হলো হার্ট অ্যাটাকের প্রধান ও প্রথম লক্ষণ। তাই বলে বুকে ব্যথা হলে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নয় এমন অবহেলাও কাম্য নয়। অনেক সময় ফ্রোজেন শোল্ডার অ্যাটাক হলে বুকে ব্যথা হয়। এ ক্ষেত্রে কাঁধে প্রচন্ড ব্যথা হয় এবং বুক চেপে আসে। গ্যাসের সমস্যা হলেও অনেক সময় বুকে ব্যথা হয় ও চাপ ধরে আসে। এটা খুবই পরিচিত একটা সমস্যা। বিষয়টি খুব দুঃশ্চিন্তার না হলে সমস্যা যদি খুব ঘন ঘন দেখা দিলে বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নেওয়া উচিত। আবার ঠিক হার্ট অ্যাটাক নয়, তবে হৃদযন্ত্রে অন্য কোনো সমস্যা থাকলেও বুকে ব্যথা হতে পারে। এটাকে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বলা হয়। এ ধরনের সমস্যা থাকলে হৃৎপিন্ডের পেশিতে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় এবং বুকেও ব্যথা হয়।
হার্ট অ্যাটাক কী ও কেন হয় : হার্ট বা হৃদযন্ত্র যদি ঠিকমতো কাজ না করে তবেই হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাক বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যাথা ২০-৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যুবরণ করে। করোনারি আর্টারি নামে হৃৎপিন্ডের গায়ে থাকে দুটি ছোট ধমনি। এরাই হৃৎপিন্ডে পুষ্টির জোগান দেয়। কোনো কারণে এই করোনারি আর্টারিতে যদি ব্লক সৃষ্টি হয়, তাহলে যে এলাকা ওই আর্টারি বা ধমনির রক্তের পুষ্টি নিয়ে চলে, সে স্থানটিতে হৃৎপেশি কাজ করে না। আর তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগের অনেক কারণ আছে। প্রাথমিক ও প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- তেলযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, মানসিক চাপের মধ্যে থাকা, রক্তে খারাপ কোলেস্ট্রলের মাত্রা বেড়ে গেলে এবং ভালো কোলেস্ট্রলের মাত্রা কমে গেলে, খাদ্যে এন্টি অক্সিডেন্টের অভাবে, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং মদ্যপানের কারণে, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও ওজন বৃদ্ধি পেলে। তবে সবসময় মনে রাখবেন, মনসিক চাপ এমন একটি ক্ষতিকর প্রক্রিয়া যা একাই হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া হার্ট অ্যাটাকের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্য রয়েছে- বয়স, লিঙ্গ ও বংশ পরম্পরা।
হার্ট অ্যাটাক কখন হয় : আমরা সাধারণত ধারণা করি বয়স হলে, ফ্যাটি বা মোটা হলে কিংবা অতিরিক্ত টেনশনের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাক অনেক কারণে ও যেকোনো সময় হতে পারে। যেমন : ঘুমের সময়, বিশ্রামের সময়, ভারী কায়িক পরিশ্রমের পর কিংবা ইমোশনাল স্ট্রেসের সময় হতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন : বুকে প্রচ- ব্যথা হলে মনে হবে ভারী কিছু একটা যেন বুকের ওপরে বসে আছে। মনে হবে যেন বুক চিপে ফেলছে। ব্যথার ব্যান্ড বুকের চারপাশে অনুভব করবেন। হজম হবে না, পেটের ওপরের অংশে জ্বালাপোড়া করবে। অতি দ্রুত ও ছোট ছোট শ্বাস-প্রশ্বাস। ঘেমে যাওয়া। অজ্ঞান হওয়া। চোখে ঝাপসা দেখা। বমি হওয়া ইত্যাদি হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ।
বাঁচতে হলে জানতে হবে : মনে রাখবেন ব্যথা শুরু হওয়ার পরে এবং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত ১০ সেকে- সময় থাকে। এমন অবস্থায় নিজ চেষ্টায় বারবার জোরে জোরে উচ্চস্বরে কাশি দিন। লম্বা করে শ্বাস নিন। আবার কাশুন এবং দীর্ঘশ্বাস নিন। বারবার এমন করলে ফুসফুসে স্পাটাম/মিউকাস উৎপন্ন হবে, আপনি পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাবেন। কাশির ফলে আপনার হৃদযন্ত্র সংকোচন-প্রসারণ হবে। তাহলে হৃৎপি-ের ভেতর দিয়ে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
প্রতিরোধে করণীয় : প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন অথবা ব্যায়াম করুন। শারীরিক পরিশ্রম করুন। মানসিকভাবে আনন্দে থাকার চেষ্টা করুন। ধূমপানসহ সব ধরনের নেশামুক্ত জীবনযাপন করুন। দুশ্চিন্তামুক্ত হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখুন। ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখুন। চর্বিজাতীয় খাদ্য কম খান। শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খান। দেহের অতিরিক্ত ওজন কমান।
প্রয়োজন ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ : হৃদরোগকে খাদ্যবাহিত রোগও বলা হয়। দেশে ফাস্টফুড খাবারের আসক্তি বেড়ে গেছে। উচ্চমাত্রার কোলেস্টরেল, চর্বি, টেস্টিং সল্ট সমৃদ্ধ খাবারের কারণে শরীরের বাঁধছে অসুখের বাসা। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে হৃদযন্ত্রের অনুকূল পরিবেশ গড়তে টিভি ও রেডিওসহ গণমাধ্যমে ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন প্রচারে নিয়ন্ত্রণ ও অস্বাস্থ্যকর খাবারে উচ্চহারে কর আরোপের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যস্ততার কারণে স্বাস্থ্যকর নয় জেনেও অনেক অভিভাবক সন্তানদের ফাস্টফুড বা তেল-চর্বিযুক্ত খাবার টিফিন হিসেবে দিচ্ছেন। এর ফলে বাচ্চার শৈশব থেকেই হৃদরোগের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। তাই এর সমাধানে স্কুল থেকে স্বাস্থ্যসম্মত টিফিন দেওয়ার উদ্যোগ নিতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"