সাধন সরকার

  ০৩ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে...

জলবায়ু পরিবর্তন এখন অলীক কোনো বিষয় নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ বৈশি^ক উষ্ণায়ন। বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন, পৃথিবী জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার উপকূলীয় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। সম্প্রতি বিশ^ব্যাংকের ‘দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু উপদ্রুত এলাকা (হটস্পট), জীবনমানের ওপরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এতে ১৩ কোটি ৪০ লাখ (২০৫০ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হবে ২০ কোটির বেশি) মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ ক্ষতির দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বনভূমি, জলাশয় ও জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলে জলবায়ুর প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি! জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্য, কৃষি, অভিবাসন ও উৎপাদনশীলতায় বিরূপ প্রভাবসহ নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এখনই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ উপকূলীয় স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। ফলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে (প্রতি সাত জনে একজন)। এ ছাড়া সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী কয়েক দশক পর চট্টগ্রাম বন্দরও সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে!

মানব সম্প্রদায়ের নানাবিধ নেতিবাচক কর্মকা- পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতিকে আরো ত্বরান্বিত করছে। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অতিমাত্রায় আরাম-আয়েশের ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্বনডাই-অক্সাইড তথা গ্রিন হাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন ঘটছে। গ্রিন হাউস গ্যাস বিশেষ করে কার্বনডাই-অক্সাইড তাপ ধরে রেখে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশে^র যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নামক পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ অন্যতম। বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যেতে শুরু করেছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে ঋতবৈচিত্র্যের খামখেয়ালিপনায় কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। গ্রীষ্মকাল ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বর্ষাকাল তার সময় থেকে সরে যাচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হচ্ছে দেশের ব্যাপক অঞ্চল। আবার গ্রীষ্মকালে দেখা দিচ্ছে খরা। শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুর চিরচেনা রূপের বৈচিত্র্য আর দেখা মিলছে না। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের ওপর। ঋতুভিত্তিক ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের ওপর নতুন রোগের প্রভাব বাড়ছে। বাড়ছে লবণাক্ততা। জলবায়ুর এই ক্ষতিকর প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানুষজন কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য সুবিধাজনক পেশায় চলে যাচ্ছে। জলবায়ুর কারণে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শহরগুলোতে অভিগমনের হার বাড়ছে। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জার্মানওয়াচ’ গত ১৯ বছর ধরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাবের ভিত্তিতে ‘বৈশি^ক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারও বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে (শুধু গেল বছরের বিবেচনায় বাংলাদেশ রয়েছে ১৩তম অবস্থানে)। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ^ব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের কারণে বিশে^র অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। এ ছাড়া দূষণের কারণে ২০১৫ সালেই শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে দূষণের শিকার হয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। যাই বলা হোক না কেন, এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ নানা উদ্যোগ নিতে থাকবে, আর উন্নত বিশ^ কার্বন নিঃসরণ করতে থাকবে এটা হতে পারে না।

প্রতিটি নতুন বছর আসছে আর পুরনো বছরের কার্বন নিঃসরণের হারকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশ ও গোষ্ঠীগুলো কার্বন নিঃসরণের মূল হোতা। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। ফলে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। এ কারণে অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের উপকূলের জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। ফসল উৎপাদন কম হচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষজন দীর্ঘদিনের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই কার্বন নিঃসরণকারী উন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক কাতারে এসে দায় নিয়ে ‘প্যারিস চুক্তির’ শর্ত মেনে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণে জোর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো কোনোভাবেই দায়ী নয়। কার্বন নিঃসরণ তথা বিশে^র তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে এক কাতারে এসে প্রতিবাদ করার, রুখে দাঁড়াবার, ক্ষতিপূরণ চাওয়ার এখনই সময়। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে নিজেদের মতো করে ক্ষতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। সম্প্রতি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ গ্রহণ করা হয়েছে। সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলাসহ পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি, মৎস্য, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প, বনায়ন, টেকসই নদী ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় রেখে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ‘সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়’ এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এটা খুব ভালো সমাধান হতে পারে। যাইহোক, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশসমূহকে ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ মেনে নেওয়াসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে জলবায়ুসহিষ্ণু শস্য উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিটা মূলত সবার। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ^কে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে প্রতিটি দেশকে অগ্রসর হতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close