নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৩ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক বাস্তবতা, যা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েজ দিয়াজ ক্যানেল বারমুদেজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আগেও অন্যতম দূষণকারী দেশ ছিল, এখনো আছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসে দেশটির বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে।’

জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০১৮ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত, গত ২০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জিডিপিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা ২০০৯ অনুসারে ১৯৮৮ সালের বন্যায় সমগ্র দেশের ৬০ ভাগ ভূমি প্লাবিত হয়, যেখানে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। গৃহহীন হয় ৪৫ মিলিয়ন মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি, প্রাণী ও মৎস্যসম্পদ খাতগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কৃষির উৎপাদন কমে যাচ্ছে, সংক্রমণ রোগ বাড়ছে। অত্যাধিক তাপের কারণে শ্রমিকের কর্মশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। নদী ভাঙনের কারণেও প্রতিবছর কৃষি জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে এবং বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরের বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে অসংখ্য মানুষ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর, রাজধানী ঢাকার হোটেল সোনারগাঁয়ে ‘দক্ষিণ এশিয়ার উপদ্রুত এলাকায় জীবনমানের ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের প্রভাব’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত ৬০ বছর ধরে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে। ঝুঁকি মোকাবিলায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সুপারিশ অনুসরণ করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বার্ষিক গড়ে ১ ডিগ্রি থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর ব্যবস্থা না নিলে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ২০১৫ সালে এ অঞ্চলে বাড়তি তাপমাত্রার কারণে ৩ হাজার ৫০০ মানুষ মারা গেছে। ভবিষ্যতে এমন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দক্ষিণ এশিয়ায় আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ। একই কারণে ভারতীয় মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় ও তৎসংলগ্ন স্থলভূমিতে বন্যার প্রাদুর্ভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ঢাকা, করাচি, মুম্বাই ও কলকাতার মতো নগরগুলোতে অন্তত ৫ কোটি বাড়তি লোকের চাপ সৃষ্টি হবে।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মান বছরে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। ২০৫০ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। একই সময়ে কার্বন নিঃসরণে তীব্রতার কারণে জীবনযাত্রার ক্ষতির পরিমাণ ২ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। বিভাগ ভিত্তিক বিবেচনায় ক্ষতির শীর্ষে থাকবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে ১০টি জেলা, যার মধ্যে সাতটিই চট্টগ্রাম বিভাগের। এমনিতেই বরিশাল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকট তীব্র। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ওই সংকটকে তীব্রতর করে তুলবে এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো বড় ধরনের হুমকিতে ফেলবে।

ভৌগলিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কম ক্ষতির শিকার হবে না। এই শহরে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ২ হাজার ৩৩১ জন। এই শহরের অবকাঠামোর পরিমাণও বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে সামান্য বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা ও অসহনীয় যানজটের শিকার হয় এই নগরী। ঢকা বিভাগের পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ নারী প্রধান। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও কম নয়, ২৯ শতাংশ। এসব কারণে এখানকার মানুষের জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষমতাও কম।

জীবনযাত্রার মানের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার মান ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবনযাত্রার মান সবচেয়ে বেশি কমবে চট্টগ্রাম বিভাগের অধিবাসীদের, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে কমবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ঢাকায় জীবনযাত্রার মান কমবে প্রায় ৭ শতাংশ। খুলনায় কমবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। রাজশাহী ও রংপুরে কমবে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ও দেড় শতাংশ।

এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথা হলোÑ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া প্রত্যাশা করে। কিন্তু উন্নত দেশের কাতারে চলে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের আর্থিক ও জীবনমানের ক্ষতি মোকাবিলায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। পরামর্শগুলোর মধ্যে রয়েছে, কৃষি খাতের বাইরের খাতগুলোতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার বর্তমানে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হার আরো বাড়াতে হবে। কারণ সামনের দিনগুলোতে কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে এবং কর্মসংস্থানও কমবে। বাংলাদেশে কৃষিখাতের বাইরে ১৫ শতাংশ বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে জলবায়ু পরিবর্তনে জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে আসবে। কৃষি খাতের বাইরে ৩০ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীবনযাত্রার মান না কমে উল্টো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগের মতে, কক্সবাজার জেলাটিতে এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ রয়েছে তারপর সেখানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে। এতে ওই এলাকার পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ দেশের প্রায় ১৬ কোটি লোক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। সরকারের নেওয়া স্বল্পকার্বন কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে। দরিদ্র্য লোকদের মধ্যে ২০ লাখ উন্নতমানের রান্নাবান্নার স্টোভ বিতরণ করেছে। নদী ভাঙন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদনদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি বদ্বীপ পরিকল্পানা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকার জলবায়ুজনিত সমস্যা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে জলবায়ু পরিবর্তনকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় জিডিপির ১ শতাংশ এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের অভিযোজন ও প্রশমনে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে কৃষিকে সমযোপযোগী করতে নিজস্ব অর্থায়ন থেকে সরকার ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ঘাত সহিষ্ণু বিভিন্ন ধরনের শস্য উদ্ভাবন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অঙ্গিকার হলোÑ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা, জলবায়ু পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং উন্নতমানের পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়ন গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, উন্নত দেশগুলোর বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ মালদ্বীপসহ সাগরতীরবর্তী বিভিন্ন দেশের অসহায় মানুষ। তাই এই সমস্যা মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বকে নিজেদের দায় স্বীকার করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close