মীর আবদুল আলীম

  ০২ অক্টোবর, ২০১৮

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্ব¡রান্বিত হোক

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সারা বিশ্ব থেকে সহায়তার কথা শুনছি আমরা, কিন্তু মিয়ানমার অনড়। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এখন এমন প্রশ্নই সামনে আসা স্বাভাবিক, যারা বলছেন তারা সবাই কি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক? তা না হলে মিয়ানমার এত শক্তি পায় কোত্থেকে, তাদের শক্তির উৎসই বা কী? তবে সবকিছুর পরও আশার আলো দেখছি আমরা। ৩০ জুন রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে আসেন। একই দিনে বাংলাদেশে আসেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) চেয়ারম্যান পিটার মাউরা। আসেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক ইয়াংলি লিসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রায় একডজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। জাতিসংঘসহ বিশ্বের চার সংস্থার প্রধানের ঢাকা সফর নিঃসন্দেহে তাৎপর্যময় ঘটনা। রোহিঙ্গাদের শুধু স্বদেশে প্রত্যর্পণ নিশ্চিত করলেই হবে না, দায়ীদের বিচারও করতে হবে। নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মহাসচিব গুতেরেস টুইট করে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে হত্যা আর ধর্ষণের যে বিবরণ আমি শুনেছি, সেটা অকল্পনীয়। এক অর্থে বলা যায়, এটা জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংস্থাগুলোর একটি সমন্বিত সফর। সন্তুষ্টির কথা হলো, তারা রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতা এবং মিয়ানমার কর্তৃক যে নির্মমতা ঘটানো হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ দেওয়ার কথা নতুন করে বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছি। আমাদের এই চাপ আরো বাড়াতে হবে, যাতে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে কী করা উচিত, তা মিয়ানমার বুঝতে পারে।’ ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে এ কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমও ২ জুলাই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাওয়ার আগে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে আছেন বলে জানান। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কারো আশ্বাসই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অন্যদিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রশ্নে একের পর এক টালবাহানার আশ্রয় নিচ্ছে। এর পেছনে বিশ্ব মোড়লদের ইশারা তো আছেই। তা না হলে কেন মিয়ানমারের মতো একটি দেশ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। তারা কি চায় প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে?

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাতে পরশ্রিকাতর হয়ে পড়েছে কিছু দেশ। তারা বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা জরুরি এবং সমঝোতার মাধ্যমে এর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও তাদের আশ্রয়দান কেবলই মানবিকতার নয়। বরং মানবিকতার দোহাই দিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কুচক্রী মহল বাংলাদেশকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিতে চায়। একদিকে মুসলিম ইস্যুতে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানের দাবি তুলছে। অন্যদিকে, মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের পেশকৃত প্রস্তাবে চীনের ভেটোকে সমর্থন জানিয়েছে। এ বিষয়ে নীরব ভূমিকায় রয়েছে অন্য মুসলিম দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের বুঝেশুনে পা বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য বোঝা বৈ অন্য কিছু নয়। এ জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা জরুরি।

এ ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনা হয়েছে। তবে এমন আলোচনা অনেক হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বেদনাদায়ক এবং কষ্টের। একটি বৃহৎ বাড়তি জনগোষ্ঠীর লালন-পালন দেশটির জন্য মোটেও সহজ নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারের যে চুক্তি হয়েছে, তা কার্যকর করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সব মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের রাখাইনে নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে হবে। অতিসম্প্রতি জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করতে এত দিন মিয়ানমার রাজি হচ্ছিল না। এখন এ ব্যাপারে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। আন্তর্জাতিক চাপ এভাবেই অব্যাহত রাখতে হবে যেন মিয়ানমার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকবেন বলে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের পূর্ণ মর্যাদায় তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসনে রাজনৈতিক সমাধান ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরতে পারে। জাতিসংঘের মহাসচিবের এসব বক্তব্যকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বাংলাদেশকে ৪৮ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার তথ্য জানিয়ে বলেন, এ সংকট মোকাবিলায় তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবেন। এতে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের একটি সংস্থান হবে নিশ্চয়ই; তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি। আমরা চাই দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। এ জন্য বিশ্ববাসী আমাদের পাশে থাকুকÑএটাই কায়মনে প্রত্যাশা করি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close