রীমা আক্তার

  ০২ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

সারা বিশ্বের নাগরিক আমি

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার এক বক্তব্যে বলেন, ‘আগামী দিনের নেতৃত্ব অর্জন করতে চাই বিশ্বনাগরিক হওয়ার যোগ্যতা’। বিশ্বনাগরিক (Global citizen) কথাটি অতিসাম্প্রতিক হলেও এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০ খ্রি. পূ-৩৯৯ খ্রি. পূ) নিজের পরিচয় দিতেন এভাবে, ‘আমি গ্রিকের নই, আমি এথেন্সের নই, বরং আমি সারা বিশ্বের নাগরিক’। ইংরেজ ও আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী, দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯) বলেন, ‘সারা বিশ্বই আমার দেশ, প্রতিটি মানবই আমার ভাই।’ আধুনিক যুগে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, সাবেক সফটওয়্যার নির্মাতা বিল গেটস তার বক্তব্যে বলেন I think of myself as a global citizen। উইকিপিডিয়ার মতে, বিশ্বনাগরিক হলো এমন এক মানবদর্শন, যেখানে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে এক পরিচয়ে বেড়ে উঠতে পারে। উত্তর-আধুনিক একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিশ্বনাগরিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বনাগরিক হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগরিক বিশ্বনেতৃত্ব ও কর্তব্য পালনের যোগ্যতা অর্জন করে। বিশ্বনাগরিক তৈরির জন্য বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শিক্ষায় বিশ্বনাগরিক বা বিশ্বনাগরিক হওয়ার শিক্ষা (Global Citizenship Education) একটি অতি সাম্প্রতিক ইস্যু। দৃশ্যত বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রসারিত হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। নিত্যনতুন তৈরি হচ্ছে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাসের হার। এ দেশে নারী শিক্ষার হারও এশিয়া মহাদেশে অনুকরণীয়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কতটুকু বিশ্বনাগরিক তৈরিতে সক্ষম। তৃণমূল পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক। পাঠ গ্রহণের উদ্দেশ্য এখনো সিংহভাগ মহলের কাছে সার্টিফিকেট এবং চাকরি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও শিক্ষার্থী মহলে শিক্ষার লক্ষ্য জিপিএ-৫ নামক সোনার হরিণে বন্দি। ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পেলেই অভিভাবকের জাত বাঁচে। বিদ্যালয়গুলোও পাল্লা দিয়ে ক্যানভাসিং করছে জিপিএ-৫-এর ফিরিস্তি। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবকও প্রশ্নফাঁস বা অসদোপায়ের পিছনে ছুটতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় একদিকে যেমন রয়েছে, প্রশাসনিক জটিলতা, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামের সীমাবদ্ধতা। ফলে বিশ্বনাগরিক তৈরির স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থায় উৎপাদিত শিক্ষার্থীরা হয়ে যাচ্ছে অসহনীয় ও বৈষম্যবাদী মানসিকতার।

উইকিপিডিয়ার মতে, বিশ্বনাগরিক শিক্ষা হলো এমন এক নাগরিক বোধ, যাতে বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা পরিবেশবিষয়ক কাজে। বিশ্বনাগরিক শিক্ষাকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, বিশ্ব সচেতনতা (Global consciousness) এবং বিশ্ব দক্ষতা (Global competence)। বিশ্বদক্ষতার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ব উন্নয়নে নিজেকে যোগ্য করে এবং ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন (২০১১) বলেন, We must foster global citizenship. Education is about more than literacy and numeracy–it is also about citizenry. Education must fully assume its central role in helping people to forge more just, peaceful and tolerant societies.

বিশ্ব নাগরিক তৈরিতে বিদ্যালয়গুলোকে রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা, শুধু জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা নয়, ভূমিকা রাখতে হবে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে, বিশ্বদর্শনে, বিশ্ব সম্প্রতি তৈরিতে। বাড়াতে হবে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি, শেখাতে হবে সহনশীলতা। পাশাপাশি বাড়াতে হবে দক্ষতা, যাকে আমরা বলি Global competence। বিশ্বদক্ষতা তৈরির বীজ বপন করতে হবে শিক্ষার্থীদের জীবনের শুরু থেকেই। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ্যা ও ভাষাগত দক্ষতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির এ যুগে বিদ্যালয়ের পাঠদানে প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। সরকারি পর্যায় থেকে বিদ্যালয়গুলোয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রশিক্ষণ ও গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অপ্রতুল। বিশ্বনাগরিক তৈরির প্রধান কারিগর হলো বিশ্বনাগরিক বোধসম্পন্ন দক্ষ শিক্ষক, যারা প্রস্তুত করবে আগামী প্রজন্মকে বিশ্বনাগরিক বোধ ও দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে শান্তি ও সহনশীলতার পৃথিবী উপহার দিতে। বিল গেটস বলেন, Technology is just a tool. In terms of getting the kids working together and motivating them, the teacher is the most important। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শিক্ষার্থীদের বিশ্বনাগরিক ভাবনার সঙ্গে পরিচয় ও সম্পৃক্ত করিয়ে দেওয়া। ইন্টারনেটের সুবাধে হাতের কাছেই এখন পুরো পৃথিবী। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাইলেই পারেন এখন বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করতে, পাশাপাশি আয়োজন করতে পারেন বিভিন্ন ই-কনফারেন্সের, যাতে করে শিক্ষার্থীরা অবগত হতে পারে বিশ্বের বড় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে। এতে তাদের মধ্যে তৈরি হবে বিশ্বনাগরিক বোধ। বিশ্ব সংকট মোকাবিলা, বিশ্ব-অর্থনৈতিক কার্যাবলি, সমতা ও বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব তৈরিতে Global Citizen Education-এর বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা ও প্রযুক্তি জ্ঞান অত্যাবশ্যক। পাঠ্যবই ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বিশ্বনাগরিক শিক্ষা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে পাঠদান ও কার্যক্রম করানো হচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়া সময়ের দাবি। জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটে বলেছিলেন He who knows no foreign language knows nothing of his own। বিশ্বনাগরিক বোধ তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান অত্যাবশক। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো চাইলেই গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা পাঠদান ও চর্চায়। বিদেশি ভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী শৈশবকাল থেকেই বিশ্বনাগরিকবোধ নিয়ে বড় হতে পারে। প্রাচীন এক আরব প্রবাদের কথা মনে পড়ছে Learn a language, avoid a war। লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো সহনশীলতা’। শিক্ষার্থীদের সহনশীলতা শিক্ষাদানের দায়িত্বও বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের করতে হবে বৈচিত্র্য ও নানা মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বৈষষ্য ও বিদ্বেষী মনোভাব থেকে দূরে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের।

শ্রদ্ধাশীল হতে হবে সব মানুষের প্রতি মানবিকতার গান গেয়ে। ফরাসি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫) বলেন, ‘কেউ বিদ্যালয়ের একটি দরজা খোলা মানেই হলো জেলখানার একটি দরজা বন্ধ করা।’ বিদ্যালয়ের প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই সহনশীল, বৈষম্য ও বিদ্বেষমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। সেই পৃথিবীর প্রতিটি নাগরিক তৈরি হবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বনাগরিকের পরিচয় নিয়ে বিশ্বায়নের এই পৃথিবীতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close