রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০২ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সম্পর্ক জোরদার করতে হবে

আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীর বহু দেশ এগিয়ে গেছে। আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সেই সম্পদ ব্যবহার করে অর্থনীতিতে উন্নয়ন ঘটিয়েছে। কিছু কিছু দেশ আছে যারা ভৌগোলিক অবস্থানগত বিশেষ সুবিধা ভোগ করে এবং তা ব্যবহার করে তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ইউরোপের বহু দেশ আছে যারা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সমুদ্রপথে সরাসরি প্রবেশের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরশীল। অন্য দেশগুলোকে নেদারল্যান্ডস নিজের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেন্ট্রাল এশিয়ার পাঁচটি দেশ যারা আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল, তারা ইরানের পোর্ট আব্বাস ব্যবহার করে। এই দেশগুলোকে ট্রানজিট প্রদানের মাধ্যমে এবং তার পোর্ট ব্যবহার করতে দেওয়ার বিনিময়ে ইরানও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আফ্রিকান ইউনিয়নও একে অপরের সঙ্গে ট্রানজিটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছে। নেপাল, ভুটান এবং নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা যেটি বাংলাদেশের আছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার আমরা করিনি। আজকে সময় এসেছে বাংলাদেশের এই ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধাকে ব্যবহার করে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো বেগবান করার।

চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে তারাই হবে এক নম্বরের অর্থনীতি আজকে তারা চারদিকেই বন্ধু খুঁজছে। তাদের অর্থনীতিতে বিনাশুল্কে পণ্য বেচার জন্য অন্য দেশগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের এই সুযোগ অন্যদের আগেই নেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু এক অজানা কারণ বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রেও পেছনে টেনে রেখেছে। আশা করি বাংলাদেশ তার কৌশলগত অবস্থানকে অর্থনীতির কাজে লাগাতে শিখবে। বাংলাদেশ আর কতকাল রফতানির ক্ষেত্রে আরএমজিনির্ভর হয়ে বসে থাকবে! অন্য পণ্যের উপর্যুক্ততা অর্জন করতে হলে অর্থনীতিতে যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। সেটাও হতো, আমরা যদি কোনো বড় অর্থনৈতিক জোটের সদস্য হতে পারতাম। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনের বহু জাতিক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ব আরো মুক্তবাণিজ্যের দিকে এগিয়ে যাবে, আর বাংলাদেশ সেই সুবিধা নেবে, তা আপাতত আর হবে না, মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনের-পথ এখন বন্ধ। সুতরাং বাংলাদেশকে ওই পথের জন্য অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যোগে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভিয়েতনাম যদি একডজনেরও বেশি এফটিএ সই করতে পারে, আমরা কেন পারছি না? মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ ওইসব অর্থনীতিতেই প্রবাহিত হয়, যেগুলো অন্য এক বা একাধিক বড় অর্থনীতির সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যের অংশীদার। কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ প্রবাহিত হয় না। আমরা অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি বাংলাদেশ অমুক অমুক অর্থনীতির সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট সই করছে। একটি কারণ বুঝি, তা হলো বাংলাদেশ মনে করে এমনিতেই তো ভালো করছে, প্রতি বছর ৫-৬ শতাংশ করে রফতানি বাড়ছে, সেটাই বা মন্দ কী! কিন্তু ওই ভাবনার মধ্যে মিথ্যা একটি আত্মতৃপ্তি নিহিত আছে।

আমরা যেখানে থাকার কথা বা আজ রফতানির ক্ষেত্রে যেখানে যাওয়ার কথা, সেখানে থাকতে ও যেতে পারিনি। আমাদের অর্থনীতির আকার এত দিনে ৩৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা সম্ভব হতো অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ যদি বাড়ত এবং বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে ১০-১২ শতাংশের মধ্যে থাকত। শুধু একটিমাত্র পণ্য নিয়ে আমরা আজও রফতানির ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি; কিন্তু অন্য দেশ বা অর্থনীতিগুলো, যেগুলো একদিন আমাদের পেছনে ছিল বা আমাদের সমান্তরাল ছিল, তারা অনেক আগেই আমাদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের কয়েক দশক আগে যে জিএসপি দিয়েছে, তা তারা অন্য অনুন্নত দেশকেও দিয়েছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রও আমাদের তাদের বাজারে রফতানি করার জন্য জিএসপি সুবিধা দিয়েছিল; কিন্তু এখন আর নেই, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা ওই সুবিধার কোনো সুযোগ নিতে পারিনি। কারণ হলো, আমরা যে একটিমাত্র পণ্য দিয়ে আমাদের রফতানি বাস্কেটের বিরাট অংশ সাজিয়েছি, সে পণ্য মানে আরএমজি ওই সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোকে তাদের বাজারে কম শুল্কে বা বিনাশুল্কে পণ্য বেচার জন্য সুযোগ দিয়ে চুক্তি করেছে, অন্য কয়েকটি অর্থনীতির সঙ্গেও বিশেষ সুবিধা দিয়ে চুক্তি করেছে; কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তেমন কিছু ঘটেনি। বাংলাদেশ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও বেশি ট্যাক্স বা রফতানি শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরএমজি বিক্রি করছে। তাতেও বাংলাদেশ ভালো করছে।

কিন্তু ওই ভালো করার পেছনে রয়েছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কস্ট কম্পিটিটিভনেস বাংলাদেশ তাদের শুল্ক দিয়েও কমমূল্যে বিক্রি করতে পারে বলে ওই বাজারে রফতানি বাড়ছে। তবে সেই প্রবৃদ্ধিও থেমে যেতে পারে, ভিয়েতনামসহ অন্য দেশগুলো যদি বিশেষ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রীয় বাজারে আরএমজি পণ্য নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরএমজি’র জন্য চাহিদা অসীম নয়। ওই চাহিদা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের। সেই চাহিদা ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াও পূরণ করতে পারে। আমরাও পারি। ওরা পূরণ করলে আমরা পিছিয়ে পড়ব আর ওরা না পারলে আমরা সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করব। চীন কিন্তু পোশাক খাতের অন্য রফতানি দিয়ে আজও এক নম্বরে আছে। চীনের আরএমজি পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি সুবিধা হবে বটে, তবে সেই সুবিধাটা ভিয়েতনামই বেশি নিতে পারে। মাত্র কয়েক বছর আগ পর্যন্ত ভিয়েতনামের রফতানিমূল্য আমাদের পেছনে ছিল, এখন তারা আমাদের থেকে অনেক আগে চলে গেছে। এখন বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ট্রেড পার্টনার বানাচ্ছে। বাংলাদেশকে আজতক এককভাবে কোনো বড় অর্থনীতি বিশেষ সুবিধা দেয়নি। চীন-ভারত যেসব সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দিয়েছে বলে বলা হয়, এমন সুবিধা তারা অন্য দেশকেও দিয়েছে। বাংলাদেশ শুনেছি কয়েকটি ছোট অর্থনীতির সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করার জন্য আলোচনা করছে। ওইসব অর্থনীতির মধ্যে আছে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, তুরস্ক আর নেপাল-ভুটান! অতি সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও এফটিএর কথা ভাবা হচ্ছে। তবে সত্যি হলো, আমাদের অবস্থান এখনো আবছা এবং আলোচনায়ই আছে, বাস্তবরূপ লাভ করেনি।

চীনও আমাদের সঙ্গে একটি এফটিএ সই করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের আগ্রহ দেখানোর অন্যতম কারণ হলো স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান, যে কারণে তারা বাংলাদেশকে মূল্য দেয়; কিন্তু আমাদের সরকার এখানেও যেন পিছিয়ে আছে। এক পা আগায় তো দুই পা পেছনে চলে যায়। চীন যে এফটিএ সই করার জন্য অফার দিয়েছে, এটাকে তো আমাদের অতি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল। আজকের দিনে বাস্তবতা হলো কোনো বড় অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংযুক্ত না হয়ে কোনো ছোট অর্থনীতিই উন্নতি করতে পারবে না। আমাদের অর্থনীতিতে বিদেশিরা, এমনকি দেশীয় ধনী লোকরা বিনিয়োগ করবে কেন? বিনিয়োগ করে তারা পণ্য ও সেবা কোন বাজারে বিক্রি করবে? আর সে জন্যই আমাদের অঞ্চল ভিত্তিতে হোক বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে হোক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির দিকে যেতে হবে। অতি অনাগ্রহীদের নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন করে কোনো লাভ হবে না। যারা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের সুবিধা দিতে চায়, তাদের দিকেই আমাদের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ভারতও আমাদের এ ক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সুবিধা আদায় করতে হলে দক্ষতার সঙ্গে দর-কষাকষিতে যেতে হবে। নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে না পারলে অন্যরা আমাদের মূল্য দেবে না। ভারতের অবস্থান হলো, কথায় তারা আমাদের অনেক সুবিধা দিচ্ছে; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আজও ভারতের বাজারে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে পারেনি। বাংলাদেশ অনেক বেশি আয় করতে পারত ট্রানজিট সার্ভিস বিক্রি করে; কিন্তু সত্য হলো এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া বাংলাদেশ যেন ভুলেই গেছে। মাঝেমধ্যে শুনতে পাই, বাংলাদেশ নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করবে। করতে পারলে ভালো হতো; কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতা লাগবে।

ভারত সহযোগিতা করলে এত দিনে নেপাল থেকে হয়তো বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়ে যেত। বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, আমরা যদি আমাদের কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন না করি, তাহলে অন্যরা এসে সে ক্ষেত্রে পরিবর্তন করে দেবে না। আমরা যতই পেছনের দিকে তাকাব, অন্যরা আমাদের পাশ কাটিয়ে যাবে। বাংলাদেশ বছরে যে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করছে, সেটা অন্যদের তুলনায় মোটেও বেশি নয়। থাইল্যান্ড গত বছর শুধু ট্যুরিজম থেকে ৫৮ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। আর ভারত শুধু স্বর্ণালংকার রফতানি করেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের। এখন বুঝুন বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়। যোগাযোগ এবং ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে আমরা যে রাজনীতির চর্চা দেখেছি, তা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর নয়। দেশ এবং জাতির স্বার্থে আমাদের রাজনীতি আরো পরিশীলিত এবং ভবিষ্যৎমুখী হওয়া প্রযোজন। সাধারণ মানুষের স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে রাজনীতিতে ব্যবহার বা অপব্যবহার করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে দলগত এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের রাজনীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ভারতবিরোধী রাজনীতির চর্চা এ ভূখ-ে নতুন নয়। শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত সব দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতাদের নিয়ে পাকিস্তানি আমলে দক্ষিণ ধারার রাজনীতির ধারক-বাহকরা ভারতবিরোধী কুৎসা রটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিল। সেই সময়কার পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখলে সহজেই এর প্রমাণ মিলবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশেও এই একই ধারার রাজনীতি এখনো চলছে। আমরা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে বুঝতে পারব, এ ধারার রাজনীতির ফলে বাংলাদেশ এবং জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নিতে সর্ববিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close