সফিউল্লাহ আনসারী

  ০১ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

বিশ্ব প্রবীণ দিবস

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ তার জীবনের কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। মানবজীবনের শেষ অধ্যায় হিসেবে প্রবীণ বয়সের এ সময় আনন্দ-বেদনা আর পাওয়া-না পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে আসে। এ সময়টাকেই প্রবীণ বয়স হিসেবে ধরা হয়। প্রবীণরা আমাদের সম্পদ, আমাদের গর্বের জায়গা। শারীরিক দুর্বলতা বা অনেক ক্ষেত্রে অক্ষমতা একজন বয়স্ক মানুষকে অসহায় করে তোলে। এ অবস্থায় যদি আবার পরিবারের সদস্যদের অবহেলা-অসহযোগিতা কপালে জুটে যায়, তবে নিদারুণ কষ্টকর জীবন নিয়ে একজন প্রবীণকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অসহায়ত্ব বেড়েই চলে। তখন আমাদের মাথার ওপরে বটবৃক্ষ এই বৃদ্ধ মানুষগুলোর আর করার কিছুই থাকে না।

এই অসহায় প্রবীণদের কথা ভেবেই বিশ্ব প্রবীণ দিবসের সূচনা হয়েছে বলে মনে করা হয়। আর এই দিবস নির্দিষ্ট তারিখে পালিত হলেও, এটা একটা দিনে সীমাবদ্ধতার জন্য নয়, প্রবীণ ব্যক্তিদের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিতেই এ দিবস সারা বছর আমাদের সেবার মনোভাবে উৎসাহী করে রাখে। আমাদের ভরসার স্থল এই প্রবীণ মানুষগুলোকে ভালো রাখা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রম যেন কোনো প্রবীণের শেষ বয়সের ঠিকানা না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি আমাদের এ বয়স্ক স্বজনদের জীবনকে সুখী করবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির সঙ্গেই দিবসের গুরুত্বকে মূল্যায়ন করে আমাদের দেশে প্রবীণ দিবস পালিত হয় ১ অক্টোবর। “১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতি বছরের এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যথাযথ আনুষ্ঠানিকতায় এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘বয়সবৈষম্য নিরসন করুন’। জাতিসংঘ অনুযায়ী, ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়।” নানা আয়োজনে এ দিবসটি পালিত হলেও অনেক প্রবীণ, যারা আমাদের দাদা-দাদি/বাবা-মা বা পরিবারের অন্য বয়স্ক ব্যক্তিদের অভিযোগÑতাদের খবর কেউ রাখে না। একাকিত্ব আর অক্ষম জীবন নিয়ে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এই প্রবীণসমাজ অনেকটা সমাজ-সংসারে বোঝা হয়ে জীবন ধারণ করে, যা মোটেই ঠিক নয়। আর এ কারণেই তাদের গুরুত্ব বোঝাতে প্রবীণ দিবস। দিবস পালনে কোনোই সার্থকতা নেই, যদি আমরা আমাদের কর্তব্যে অবহেলা করি।

জীবনের এ পর্যায়ে একজন প্রবীণ ব্যক্তি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েন, যা তার জন্য অসহায়ত্বকেই দীর্ঘায়িত করে। তবে একজন প্রবীণ যতই অসহায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে না কেন, তার কিন্তু অভিজ্ঞতার সঞ্চয় অনেক বেশিই। একজন তরুণ বা যুবকের বুদ্ধির অপরিপক্বতার তুলনায় শারীরিক দুর্বল প্রবীণ ব্যক্তির বুদ্ধির পরিপক্বতা উত্তরণের পথ দেখায়। কেবল অধিকারের প্রশ্নে নয়, একজন প্রবীণ ব্যক্তি আমাদের পরিবারের বাইরের কেউ নন বরং কেউ আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি, বাবা-মা বা অন্য কেউ যারা আমাদের আপনজন, আমাদের পরিবারের দায়িত্বশীল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ভালো আচরণ, সব ক্ষেত্রে মূল্যায়ন শুধু তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধই নয়, এটা তাদের অধীকার।

শুধু বয়সের কারণে বা বার্ধ্যকের কারণে তারা গুরুত্বহীন অবস্থায় অবমূল্যায়নের জীবন ধারণ করবেন, তা এই সচেতন ও সভ্যসমাজে হতে পারে না। তারা অবজ্ঞা-অবহেলায় থাকতে পারেন না। কারণ তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হয়েছি, আমাদের সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়েছে এই প্রবীণ মানুষগুলোর পরিশ্রমে, তাদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তায়। এই প্রবীণরা একটা মানবিক পৃথিবীর জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন, অথচ তাদের প্রতি অনাদার-অবহেলা কাম্য নয়। এই প্রবীণরাই একদিন আমাদের মতো শিশু থেকে তরুণ, যুবক অবস্থা পার করে এসেছেন। হয়তো আমাদেরও এই প্রবীণ সময়টা পার করতে হবে।

অমানবিক আচরণে প্রবীণরা কষ্ট না পেয়ে যদি জীবনের শেষপর্যায়ে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ, সফল, সার্থক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন পায়, তার জন্য দায়িত্বশীল আচরণ আমাদের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে। পরনির্ভরশীল হওয়ায় অনেক সময় আমরা প্রবীণদের অবহেলার চোখে দেখি। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিই না। অনেকটা সামাজিক ও পারিবারিক কর্মকা- থেকে তাদের দূরে রাখি বা গুরুত্ব না পেয়ে তারাই দূরে সরে যায়। এমনটা কোনোভাবেই ঠিক না, কারণ প্রবীণদের বুদ্ধিদীপ্ত দিকনির্দেশনা আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাবনাকেও নতুন পথ দেখাতে পারে। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের মানবজীবনে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল ও মুক্তি মিলতে পারে। শুধু প্রবীণ দিবস নয়, সারা বছর আমরা বয়স্ক এ মানুষগুলোর খোঁজখবর নিই, তাদের স্বাস্থ্যগত, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়ে তাদের পাশে থাকি, পাশে রাখি, তবে উভয়ের জন্যই মঙ্গল। শহরের প্রবীণরাই গ্রামাঞ্চলের বুড়ো-বুড়ি নামেই পরিচিত। প্রৌঢ় মানুষজন আমাদের সমাজেরই অংশ, তাদের দূরে রেখে সামগ্রিক কল্যাণ অসম্ভব। চাকরিজীবীদের বয়সে প্রৌঢ়ত্ব নির্ধারিত থাকলেও গ্রামের কৃষিনির্ভর মানুষগুলোর অবসর গ্রহণের কোনো নির্দিষ্ট বয়স না থাকায়, তাদের পৌঢ়ত্ব নির্ধারণ বেশ কঠিন। তবে গ্রামাঞ্চলে বুড়ো-বুড়ি নামের ব্যক্তিরাই প্রবীণ হিসেবে পরিচিত।

চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের সঙ্গেই মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধ পাচ্ছে, সেই সঙ্গে বয়স্কদের মৃত্যুহার একদিকে যেমন কমেছে, অন্যদিকে গড় আয়ুও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা তরুণ-যুবকসমাজ প্রবীণদের থেকে অনেক ভালো কিছু করার ও বাস্তব জীবনের সংকট মুহূর্তে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার শিক্ষা পেতে পারি, যা আমাদের বর্তমান ও ভীবষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় এবং তাদের জীবনকে সহজ-সুন্দর করতে পারে। কারণ প্রবীণরা শারীরিকভাকে দুর্বল হলেও বুদ্ধিতে পরিপক্ব। তাদের চিন্তার গভীরতা এবং সুদূরপ্রসারী ভাবনা মঙ্গল বয়ে আনে।

সমাজ এবং পরিবারে বয়স্করা অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা হিসেবে খুবই কষ্টকর জীবনযাপন করছেন। দরিদ্র ও অনেক পরিবারের অবহেলিত-হতভাগ্য অনেক প্রবীণ ব্যক্তি ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যের করুণার পাত্র হয়ে বাকিজীবন অতিবাহিত করেন, যা একজন প্রবীণ ব্যক্তির জন্য দুর্ভাগ্য ও অপমানজনক। আমরা জানি, প্রবীণরাই আমাদের শিক্ষক-অভিভাবক, পথের দিশারি, তাদের বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শুধু এই একটি দিন নয় আসুন প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্ত আমরা বয়সের ভারে নুব্জ্য প্রিয় মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করি। তাদের ভালো-মন্দকে গুরুত্ব দিই। তাদের সঙ্গ দিয়ে জীবনের পরিকল্পনায় তাদের বুদ্ধি ও দিকনির্দেশনাকে মূল্যায়ন করি এবং তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিই। কারণ আমরাও একদিন তাদের মতো প্রবীণ বয়স্ক জীবনে প্রবেশ করব। পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে, আমরা সম্মান পেতে প্রবীণদের প্রতি সহনশীল হওয়া আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

করুণা নয়, ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই আমরা প্রবীণদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব আমাদের মঙ্গলের জন্যই এবং এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও। সন্তানের মঙ্গল কামনায় যে বাবা-মা তাদের জীবনকে প্রৌঢ়ত্বে নিয়ে এসেছেন, সেই প্রবীণ মানুষগুলোর সুস্থ জীবনযাপনের জন্য তাদের বার্ধক্যকে সম্মানজনকভাবে কাটাতে তাদের প্রতিও সন্তানদের দায়িত্ব সম্মান প্রদর্শন করা। বর্তমান সময়ে সরকারিভাবে বয়স্কভাতা প্রদান কর্মসূচি এ অসহায় বৃদ্ধ মানুষগুলোকে তাদের পরিবারে সম্মান দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক বয়স্ক প্রবীণের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা আমাকে জানিয়েছেন সরকার প্রদেয় এই ভাতা যেন বৃদ্ধি করা হয়। কারণ যে পরিমাণ ভাতা দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। তবে এই ভাতাপ্রাপ্তিতে তারা খুশি। শুধু সরকার নয়, আমাদের প্রবীণসমাজকে ভালো রাখতে পরিবার, ব্যক্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে এনজিওগুলো বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

শুধু প্রবীণদের অধিকারের প্রশ্নে নয়, তাদের জীবনের শেষভাগ যেন স্বাচ্ছন্দ্যময় হয় এবং আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে, তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিশুদের মতো প্রবীণরাও যে সরলতা আর অন্যের মুখাপেক্ষী। আসুন আমরা প্রবীণদের নিয়ে ভালো কিছু করার জন্য নিজে সন্তান হিসেবে সচেতন হই, এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করি। সামাজিক সম্মানবোধ আর মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে আমাদের জীবনে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি এই প্রবীণদের সম্মান দিতে শিখি, তাদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলি আর তা সম্ভব পরিবারের সদস্যদের আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে। বিশ্ব প্রবীণ দিবস সফল ও সার্থক হোক।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

তথ্যসূত্র ইউকিপিডিয়া, অনলাইন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close