শতাব্দী জুবায়ের

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

অসুখের উৎসভূমি

মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সৃষ্ট ক্ষতিকর পদার্থ ও তা নির্গমনের কারণে স্বাভাবিক পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়লে তাকে দূষণ বলে। পরিবেশদূষণ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণ। পরিবেশদূষণের কারণে পরিবেশে স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। এ ছাড়া জীবজগতের স্বাভাবিক জীবন এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ব্যাহত হয়। ফলে পরিবেশের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। বর্তমান সময়ে পরিবেশদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বর্তমানের শিল্পায়ন। শিল্প-কারখানা সচল রাখতে বিভিন্ন ধরনের জীবাশ্ম জ¦ালানি, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে এই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দূষণের প্রধান উৎস।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বড় এবং ছোট উভয় ধরনই শহরের ওপর প্রভাব ফেলছে। জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবন বানানোর কারণে শহরের বিভিন্ন অংশ বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ছোট ছোট নগর পরিবেশদূষণের শিকার হচ্ছে। অবৈধ দখল রোধ এবং জলাভূমি ও খালগুলোতে বিনিয়োগ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা ও অন্য শহরে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে বাংলাদেশে বসবাসের উপযোগিতা আরো হারাবে।

দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অবস্থান অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই বিশেষ করে শহর এলাকায় পরিবেশগত অবনতি ও দূষণরোধে কাজ করতে হবে। দূষিত পানি নদী বা খালে গিয়ে পড়ে; যা রাজধানীর আশপাশের এলাকার দরিদ্র মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। জলাভূমি দখল ও বিপজ্জনক বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফেলাসহ দূষণ ও পরিবেশগত অবনতির ফলে নারী, শিশু এবং দরিদ্রদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। প্রায় ১০ লাখ দরিদ্র মানুষ সিসাদূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে (আইকিউ) ও অন্য ধরনের ক্ষতি হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃতশিশু প্রসবের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। যার ফল স্বাস্থ্য বিপর্যয়। অনেক সামাজিক সংগঠন পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কথা বলছে। কিন্তু সমস্যা হলো যারা পরিবেশদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী তারা অনেক ক্ষমতাধর। তাদের এই ক্ষমতা রাজনৈতিক। ফলে তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশদূষণ অব্যাহত রেখেছে। যেমন বিভিন্ন ইটভাটা ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানার মালিকরা।

পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, নীতিমালা আছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এসব আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করলে শাস্তিরও বিধান আছে, কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। কিন্তু সরকার চাইলে পারে। সরকারের সদিচ্ছাই পারে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে। কিন্তু সরকার যদি সুশীল সমাজের মতো শুধু কথা বলে, কাজ না করে তাহলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। পরিবেশদূষণের প্রধান শিকার নারী ও শিশু। বিশেষ করে শব্দদূষণ শিশুদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত হয়। তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে উঠতে পারে। আর অতিরিক্ত সিসা শিশুদের রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে। তারা ঠিকমতো খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়। দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃতশিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। এসব এলাকার দূষিত বায়ু এবং পানির কারণে তার নিজের এবং গর্ভেও শিশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতিরকারক হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ক্যানসার ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে বা এ রকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যানসার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি করতে পারে। দূষিত পানি বা নদীর ভেতর যেমন মাছ বা প্রাণী থাকে, যেসব ভেজষ উৎপন্ন হয় দূষণ সেসব প্রাণীর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানবদেহের শরীরে চলে আসে। ফলে সরাসরি দূষিত পানির কাছাকাছি না থাকলেও সেসব দূষিত পদার্থ এসব মাছের মাধ্যমে মানবদেহে আসে, যার ফলে ত্রুটি পূর্ণজন্ম বা ক্যানসর হতে পারে। এমনকি খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকছে সিসা, প্লাস্টিকসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা ¯œায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটির তৈরি হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে প্রেসার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যা তৈরি হতে পারে।

বর্তমান বিশ্বের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু দূষণ। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, মানুষ এখন পারমাণবিক বোমার চেয়ে পরিবেশদূষণকে বেশি ভয় পায়। পুরো পৃথিবীর মানুষ এই দূষণ নিয়ে বড়ই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আজ বিশ্বেও যেখানেই বিশ্ব রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রপ্রধানরা সম্মেলন করলে একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে আর তা হলো এই বিশ্বকে বিভিন্ন দূষণের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন হয়েছে, আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃতির ক্ষতি করতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনি। আমরা আমাদের ইচ্ছামতো নগরায়ণ করেছি, শিল্প-কারখানা তৈরি করেছি, জমির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, নদীদূষণ ঘটিয়েছি, পাহাড় কেটেছি, গাছ কেটেছি নির্বিচারে, আকাশের নির্মল বায়ুকে করেছি দূষিত। আমরা ভেবেছি প্রকৃতির এত ক্ষতি করে পার পেয়ে যাব কিন্তু না, প্রকৃতি ইতোমধ্যে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। আসুন প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা ও নিজে সুস্বাস্থ্যভাবে বাঁচার জন্য হলেও চারপাশ দূষণমুক্ত রাখি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close