অলোক আচার্য

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দৃষ্টিভঙ্গি আজও বদলায়নি

কন্যাসন্তান বা ছেলেসন্তান জন্ম দেওয়া একজন মায়ের বা বাবার ইচ্ছাকৃত কোনো বিষয় নয়। কিন্তু অবাক বিষয় হচ্ছেÑ এই নারীদেরকেই কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়। অতীতকাল থেকেই এটা আমাদের সমাজে দোষারোপ করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের দুর্ভাগ্য। আজ আমরা যারা শিক্ষিত, যারা প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি, তাদের তো একটাই কথা- ছেলে হোক মেয়ে হোক সে তো একই কথা। যেখানে প্রতি পদক্ষেপে তাকে মোকাবিলা করতে হবে বাধাবিপত্তি। একটু বড় হলেই রাস্তাঘাটগুলো তার একাকী চলার জন্য ক্রমেই বিপৎসংকুল হয়ে ওঠে। রাস্তায় লুকিয়ে থাকে মুখোশ পরা হিং¯্র শাপদ। এ রকম পশুসম মানুষ দিয়ে আমাদের সমাজটা ভরে উঠছে। ছেলেকে যেমন মানুষ হিসেবে শিক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে বাবা-মা বড় করে মেয়েকেও ঠিক একই চিন্তা ভাবনায় মানে মানুষ করার চিন্তা ভাবনায় বড় করা উচিত। ছেলে বা মেয়ে নয় বরং সন্তান মানুষ করা, তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই বড় কথা। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসে ছেলে বড় হলে চাকরি করবে আর মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে এই চিন্তাচেতনা থেকে কি আজও আমরা বের হতে পেরেছি। আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে যদিও ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক পরিবারেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই যেন মেয়ের চূড়ান্ত পরিণতি। এ কথা জন্মের পর থেকেই মনে মনে ঠিক করে রাখা হয়। এই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু তা ধীরগতিতে।

এক সময় ছেলে আর মেয়েতে ছিল বিস্তর বিভেদ। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হওয়ার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত। কন্যাশিশু জন্ম হওয়াতে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পড়ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক না বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে না। তাদেরকে নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। কত শত নিয়মের বেড়াজালে ছিল বন্দি মেয়েদের জীবন। মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হওয়াই ছিল প্রায় নিষেধ। একটা সময় ছিল লেখাপড়া করার মতো সুযোগ ছিল কম। সে অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে বেগম রোকেয়া কামালের মতো মহীয়সী নারীরা এগিয়ে এসেছেন। তারা দেখিয়েছেন পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও সমান অবদান রাখতে পারে। আজ যোগ্যতার সঙ্গে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিশ্বরাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে সমান ভূমিকা পালন করে চলেছে। পিছিয়ে নেই কোনো ক্ষেত্রেই। মেয়েরা লিখছে, পড়ছে এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। এ বছর তো এইচএসসিতে ছেলেদের থেকে মেয়েদের পাসের হার বেশি। শুধু এ বছর নয়, বরং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। সমরক্ষেত্রে যুদ্ধবিমান নিয়ে শত্রুর দিকে উড়ে চলেছে নারীরা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে চলছে না। প্রযুক্তির উৎকর্ষে পৃথিবী এগিয়েছে। সেই সঙ্গে এগিয়েছে মানুষের ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনা। চেতনার উৎকর্ষে আজ নারী পুরুষের বিভেদ, হীনম্মন্যতা সমাজ থেকে কমছে। কিন্তু আজও আমরা পারিনি সমাজ থেকে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার সমভাবে নিশ্চিত করতে। পারিনি কন্যাশিশুদের যাত্রা নির্বিঘœ করতে। আজও সমাজের অনেক জায়গায় কন্যাশিশু জন্ম নেওয়ার কারণে স্ত্রীকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। আজও কন্যাশিশু জন্ম নিলে অনেকে হীনমানসিকতায় ভোগে। এটা আমাদের অনেকের হীনমানসিকতার ব্যাপার।

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আজকের কন্যাশিশু এরা একটা শক্তি যাদের বাদ দিয়ে কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা আসবে না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নারী পুরুষ সমানভাবে অবদান রাখা জরুরি। আমাদের সমাজের কন্যাশিশুর সবথেকে বড় বাধা হলো বাল্যবিয়ে। আমাদের শহরের অবস্থা কিছুটা পাল্টালেও গ্রামের চিত্র কিন্তু ভালো নয়। গ্রামের মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্লাস সেভেন, এইট থেকেই বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন অভিভাবকরা। এসব অভিভাবকের বেশির ভাগই কিন্তু নিরক্ষর বা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বাল্যবিয়ে আজও আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় একটি বাধা। কেবল আমাদের দেশেই নয়, অনেক উন্নয়নশীল দেশরই সমস্যা এটি। বাল্যবিয়ে আমাদের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত ব্যাহত করছে। বাল্যবিয়ে একজন কন্যাশিশুর অধিকার ও সুযোগকেই হরণ করে না, বরং তার নারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করে। আমাদের মতো অনেক দেশেই কন্যাশিশু ভ্রণ অবস্থাতেই ঘৃণার শিকার হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতে নিষিদ্ধ হলেও কন্যাশিশুর ভ্রণ হত্যার হার অনেক বেশি। এর সঙ্গে জড়িত যেমন কিছু অসাধু ডাক্তার তেমনি সেই ভ্রণের অধিকারী মা ও তার পরিবার রয়েছে। সেখানে এমন অনেক রাজ্যই রয়েছে যেখানে বিয়ের উপযুক্ত পাত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা। অন্য রাজ্য থেকে রীতিমতো দালাল ধরে মেয়ে আনতে হয়। এটা প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মেয়েদের বোঝা হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা আজও তারা ত্যাগ করতে পারেনি। ফলে অনেক মেধাবী কন্যাশিশুকেই অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে মেধাবিকাশের সুযোগটাই হত্যা করা হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই আবার পঞ্চম শ্রেণির মেয়েটিকে বিয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পরিবার থেকে জোর করেই এটা করতে বাধ্য করতে হচ্ছে। এটাই আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ। কারণ যেসব শিশুর এভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে, তাদের পরিবার থেকে মানসিক চাপ থাকে বিয়ে করার জন্য। এসব হচ্ছেও কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে। মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর থেকে বিয়ে দেওয়াটাই যেন তাদে লক্ষ্য। কিন্তু ওরাও যে এক দিন বড় হয়ে ছেলেদের পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরবে, এ কথা যেন মাথাতেই থাকে না বা বিশ্বাস করতে চায় না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে কন্যাশিশু ও নারীদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। যেকোনো মূল্যেই বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। এটা শুধু কর্তৃপক্ষ নয় বরং তাদের পাশাপাশি শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবকসহ প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের তার কন্যাশিশুকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রত্যয় নিয়ে বড় করতে হয়। তাদের ছেলেসন্তান থেকে আলাদা নয়, বোঝা নয় বরং মানুষ করার, সুশিক্ষিত করার প্রত্যয় ধারণ করতে হবে। দেশের উন্নয়ন করতে হলে নারীর উন্নয়ন আবশ্যক আর আজকের কন্যাশিশু আগামী দিনে একজন প্রতিষ্ঠিত মহীয়সী নারী।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close