আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সম্ভাবনাময় শিল্প খাতে আমরা

বাংলাদেশের প্রবল সম্ভাবনাময় শিল্প ‘তৈরি পোশাকশিল্প’। এ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তবে কিছু কিছু কারণে টানাপড়েন চলছে এ শিল্পে। ব্যবসা ও শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ, মজুরি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও এ শিল্পের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু নীতি গ্রহণ করতে হবে বা যুগোপযোগী করতে হবে। বিদ্যুৎ-তেল ও জ্বালানির জন্য ‘জ্বালানি নীতি’ গ্রহণ করা যেতে পারে। তাহলে বিপুল সম্ভাবনাময় এ শিল্প থেকে আমরা আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাব, অর্থনীতি চাঙা হবে। পরোক্ষ হিসেবে অন্য সেক্টরের গতি আনবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাব। তৈরি পোশাকশিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল করছে এবং রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ অর্জন করছে।

‘স্টিচেস টু রিচেস : দক্ষিণ এশিয়ায় পোশাক খাতে কর্মসংস্থান, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের গত বছরের একটি গবেষণায় দেখা যায়, চীনে পোশাক খাতের পেছনে এক শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি এ পণ্য রফতানির সুযোগ বাড়বে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চীনে শতকরা ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য নতুন করে আরো চার দশমিক ২২ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ র‌্যাংকিং অনুযায়ী ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বিশ্ব বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা ২০১৭ অনুসারে, বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের বাজারে বাংলাদেশের অংশ বাড়ছে। ২০১৫ সালের পাঁচ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে, চীনের শেয়ার পরতির দিকে। ২০১৫ সালে যা ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল, তা কমে এখন ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।

রফতানি পণ্য তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে পাট ও চায়ের পর অনিবার্যভাবে যে পণ্যটির নাম চলে আসত তা হলো চামড়া। তবে আমাদের চামড়া খাত বাজার ধরতে পারছে না। পরিবেশদূষণের কারণে বাংলাদেশের ট্যানারি বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মানসনদ দিচ্ছে না। বিশ্বের ৬৬টি বড় ব্র্যান্ডের সদস্য। এলডব্লিউজি মান সনদহীন ট্যানারি থেকে তারা চামড়া কেনে না। পরিবেশ সুরক্ষা, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় সনদের ক্ষেত্রে। বিশ্বের ৪৪০টি কারখানা এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে ২৪২টি গোল্ড সনদ। ভারত ১০৫টি, চীন ৭৫টি, ব্রাজিল ৬৩টি, ইতালি ২৬ টি, ভিয়েতনাম ১৪টি, পাকিস্থান ৩টি ও বাংলাদেশ ১টি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া খাতের সার্বিক রফতানি আয় কমেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বৃদ্ধির প্রবণতার পর গত বছরই এ খাতে রফতানি আয় কমেছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্থানের রফতানি আয় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ চামড়ার জুতা রফতানি করছে। বাংলাদেশে আগে জুতা তৈরি হলেও তা দ্বারা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা হতো। এখন জুতা রফতানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে জুতাশিল্পের বিকাশের চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, আমাদের দেশে শ্রম সস্তা ও উৎপাদন খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম। উন্নত দেশগুলোতে জুতা তৈরির মোট খরচের ৪০-৪৫ শতাংশ ব্যয়িত হয় শ্রমিকের মজুরি বাবদ। আমাদের দেশে তা মাত্র ৫ শতাংশের মতো। জাপানে একজন জুতা শ্রমিকের প্রতি ঘণ্টায় মজুরি ২৩ দশমকি ৬৫ ডলার। বাংলাদেশে এ হার মাত্র শূন্য দশমকি ২৩ ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজোড়া চামড়ার জুতা তৈরি করতে খরচ হয় ৩২ ডলার, যা বাংলাদেশে ১৪ ডলার। একটু উদ্যোগী আর ব্যবসায়ীরা আন্তরিক হলেই এ সুযোগ কাজে লাগানো যাবে। অবশ্য এ সুযোগ অন্য শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রায় একই। উৎপাদন খরচ ও আউটপুটের হারের ব্যবধান অনেক বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জুতা প্রস্তুতকারী দেশ চীন এখন বিশ্ববাজার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে গার্মেন্টসের মতো আমাদের দেশে এখন এ খাতের ব্যবসা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। বিপুল সম্ভাবনাও আছে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার।

পাটের পলিমার থেকে যেটা পচনশীল এক ধরনের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তিতে এই পলিব্যাগ পলিথিনের মতোই দেখতে ব্যাগ, কিন্তু পাট দিয়ে তৈরি! পলিথিনের চেয়েও দেড়গুণ মজবুত এই ব্যাগ। সোনালি ব্যাগে ৫০ শতাংশের বেশি রয়েছে সেলুলোজ, যা পানিতে ভিজলে বা মাটিতে ফেললে দ্রুত পচে যাবে। ফেলে দেওয়ার পর মাত্র চার থেকে পাঁচ মাসেই পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশে যাবে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই! এটার নাম ‘সোনালি ব্যাগ’। এই ব্যাগে পরিবেশ দূষিত হবে না। দেখতে অনেকটা প্লাস্টিকের পলিব্যাগের মতো এই ব্যাগ টেকসই এবং অধিক ভার বহনে সহায়ক। এই সোনালি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। তা ছাড়া পাটের ছোট ছোট ব্যাগও ব্যবহার করা যায়। এমনকি ফ্যাশনের জন্যও ব্যবহার করা যায়। ‘সোনালি ব্যাগ’ ব্যবহার করার পর ফেলে দিলে সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উপরন্তু তা মাটিতে সারের কাজ করে। সহজলভ্য উপাদান এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এ পলিথিন ব্যাগ বিদেশে রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ সোনালি ব্যাগ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আয়ের খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ‘খরভব ইষড়ড়ফ’ হিসেবে কাজ করে, ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প হতে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

আমাদের পর্যটনশিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের পার্শ¦বর্তী অনেক দেশ যেখানে এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা স্থবির হয়ে আছি। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ ও থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির বেশির ভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩ দশমকি ৯ ভাগ। ২০২০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বেড়ে ৪ দশমকি ১ ভাগ হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আবার বাংলাদেশ বর্তমানে এই খাত থেকে যেখানে প্রায় ৭৬ দশমকি ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক আয় করে সেখানে সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ১০ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, মালদ্বীপে ৬০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং নেপালে এর পরিমাণ ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুতরাং, সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আদর্শ হতে পারে। আমাদের সম্ভাবনাও প্রচুর রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। ইতোমধ্যে পর্যটন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক-তৃতীয়াংশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটনশিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close