নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

অর্থনীতিতে পরিবেশদূষণ

পরিবেশের ক্ষতি করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, এটা পরীক্ষিত সত্য। পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো দেশের সাময়িক উন্নয়ন হতে পারে, কিন্তু সেই উন্নয়ন টেকসই হতে পারে নাÑ চীন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মাটি, পানি ও বাতাস দূষিত করে চীনে উন্নয়নের নামে পরিবেশের যে ক্ষতি করা হয়েছে, তা ছিল মারাত্মক ভুল। চীনের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। যে উন্নয়ন মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সহায়ক নয়; পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর, সে উন্নয়ন কারো কাম্য হতে পারে না।

পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবেশ দূষণে ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছে ৮০ হাজার ২৯৪ জন। বায়ুদূষণ, আর্সেনিকযুক্ত পানি, কর্মক্ষেত্রে দূষণজনিত কারণে মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ ঘণ্টা। দূষণের কারণে মৃত্যু ও কর্মঘণ্টা হারিয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতি ৬৫২ কোটি ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকা। এই ক্ষতি ওই সময় দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে বিশ্বে যত মানুষ মারা গেছে তার ১৬ শতাংশ পরিবেশ দূষণের কারণে হলেও বাংলাদেশে এর পরিমাণ ছিল শতকরা ২৮ শতাংশ। এই হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে ৯৭তম।

সম্প্রতি রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীলতা উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২০০৬ সালের পর বিশ্বব্যাংক এই সমীক্ষাটি প্রকাশ করে। তবে এবারের সমীক্ষাটির প্রধান বিষয় হলো শহরের দূষণ। মূলত শহরের বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ, ঘরের ভেতর বায়ুদূষণের মাত্রা, পানি দূষণ, স্যানিটেশন ও কর্মক্ষেত্রে দূষণকে সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিশ্বব্যাংকের একদল গবেষক। প্রতিবেদনটিতে মূলত পরিবেশের আর্থিক ক্ষতি, শহরে পরিবেশ দূষণের ধরন ও পরিবেশ সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের ফলে প্রতিবছর জিডিপির ১ শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশ দূষণকারী শিল্পকারখানা ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে নগরের বাতাস এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ পরিমাপ করে দেখা গেছে, এখানে মানমাত্রার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ক্ষুদ্র বস্তুকণার অস্তিত্ব রয়েছে। শীতকালে বিশেষ করে অক্টোবর মাস থেকে বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়, যা মানবদেহে প্রবেশ করে নানা প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করে। মূলত পাঁচটি উৎস থেকে বায়ুদূষণের উপাদানগুলো আসছে। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ আসে ইটভাটা থেকে, ১০ শতাংশ যানবাহনের ধোঁয়া থেকে, ৮ শতাংশ করে আসে মাটি ও সড়কের ধূলা থেকে এবং বাকি ৭ শতাংশ আসে কাঠসহ নানা ধরনের বস্তু পোড়ানো থেকে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, দেশের শহরগুলোতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে বসবাস করছে; যাদের বেশির ভাগই শিশু। এ দূষণের কারণে তাদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। এসব শিশুর বেশির ভাগই দরিদ্র এবং বস্তি এলাকায় বসবাস করে। বসত এলাকায় ফেলে দেওয়া ব্যাটারিসহ শিল্পবর্জ্যের কারণে ওই দূষণ ঘটছে।

দূষণের কারণে শুধু রাজধানী ঢাকায় ২০১৫ সালে ১৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। আর ৫ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এ দূষণ রাজধানীতে বসবাসরত বিশেষত শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা। বড় এ রফতানি খাতের শ্রমিকদের এ ক্ষতির কারণে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঢাকার চারপাশের চারটি নদীকে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ নদীগুলোর তীরে ৭১৯টি ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রতিটন কাপড় তৈরি ও রং করতে ২০০ টন বর্জ্য পানি তৈরি হচ্ছে, যা নদী ও জলাশয়ে পড়ে পানি দূষিত করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণয়ের ফলে বড় ও ছোট শহরগুলোতে পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে রাজধানীর প্রায় ৭৫ শতাংশ জলাভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব জলাভূমিতে উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে। আর শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পাবনার মতো একটি ছোট শহর ৯০ দশকে গড়ে উঠেছে। এ সময়ের মধ্যে এ শহরের অর্ধেক জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে। শহরের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত ইছামতি নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা সম্পর্কে বলা হয়, ২০১৭ সালে ২২ অক্টোবর ২৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে বৃহত্তর ঢাকার ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। মূলত নদী-খাল ও জলাভূমি দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে পড়তে পারছে না। আর তা শহরের মধ্যে জমা হচ্ছে।

অবৈধ দখল রোধ ও খাল-জলাভূমি রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে জানান বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক প্র্যাকটিস ম্যানেজার কেসনিয়া লভভস্কি। তার মতে, এটা সম্ভব। নরসিংদীর মাধবদীর মতো ছোট শহরটিতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় সাফল্য দৃশ্যমান। সেখানে দেখা গেছে, নগর পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ, সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় মনেবলের স্থানীয় নেতৃত্ব অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দূষণের ধারা পাল্টে দিয়েছে। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগ নিয়ে সেখানকার পরিবেশ সুরক্ষা করছেন। তারা শহরটিকে বাসযোগ্য করার জন্য কাজ করছেন।

বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞগণের মতে, বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি দুর্বলতা ও সম্পদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও উচ্চপ্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে দূষণ রোধ করা এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী পারালকার বলেন, শহরগুলোতে পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশের উচ্চপ্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। আর শিল্পগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের আর্বান স্টাডিজ প্রোগ্রামের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার আবাসিক এলাকায় পরিবেশ দূষণকারী ১ হাজার ৪২টি শিল্পকারখান রয়েছে। এসব শিল্পকারখানার ৭৫ শতাংশই লালবাগ, সূত্রাপুর, মিরপুর ও কোতোয়ালির মতো চারটি জনবহুল আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এ ছাড়া ঢাকার প্রায় সব আবাসিক এলাকাতেই কম-বেশি দূষণকারী শিল্পকারখানা রয়েছে। দূষণকারী কারখানা হতে নির্গত ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস, চলমান যন্ত্রপাতির তীব্র শব্দ ও শ্রমিকদের কলরব, শিল্পবর্জ্য প্রভৃতির মাধ্যমেও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দূষণকারী শিল্পের মাধ্যমে বাতাস, পানি, মাটি এবং শব্দদূষণ হয়ে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আবাসিক এলাকায় অসহনীয় যানজট। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের এবং অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীনে পরিবেশবিষয়ক আদালত কাজ শুরু করেছে। প্রতিবছর ভুক্তভোগী এবং সচেতন কর্মীদের দায়ের করা পরিবেশবিষয়ক মামলাগুলো যাতে দীর্ঘসূত্রিতার মুখোমুখি না হয়, সে জন্য দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কিংহাই প্রদেশে এই বিশেষায়িত আদালত চালু করা হয়েছে। এর ফলে প্রদেশের পরিবেশ সুরক্ষা হবে এবং নাগরিকরা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উৎসাহিত হবে। আমাদেরও পরিবেশ সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close