অলিউর রহমান ফিরোজ

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

নদী ভাঙনের পদাবলি

আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। আগে নদীগুলো ছিল গভীর ও স্রোতস্বিনী। তাই নদীতে পলি পড়া সহজ ছিল না। স্রোতের টানে পলি গিয়ে পড়ত সমুুদ্রে। তাই সমুদ্রে জেগে উঠেছে অনেক বড় বড় চর। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুম ছাড়া তেমন স্রোত এবং নদী প্রবাহিত হতে দেখা যায় না। নদীর গভীরতা থাকলে তাতে বিপুল পরিমাণ পানি তার বক্ষে ধরে রাখা সম্ভব না। কিন্তু কালক্রমে গভীর এবং প্রবাহিত নদীগুলোর গভীরতা কমে এসেছে। তাই বর্ষার স্বাভাবিক পানি ধরার ক্ষমতা নদীগুলোর আর নেই। আগে শুধু নদীগুলোই যে পানি ধরে রাখত, তা-ই নয়। বর্ষার মৌসুমে দেশের খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওড়-বাওড় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পতিত হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশের খাল-বিল, পুকুর-ডোবা এবং জলাশয় ড্রেজিং দিয়ে ভরাট করার যেন মহোৎসব চলছে। আর নদ-নদী তো আগেই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিক বর্ষার পানিও এখন দেশের মানুষের গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। বর্ষায় যখনই নদীতে পানি বৃদ্ধি পায় তখনই নদীগুলো অগভীর থাকার কারণে তা নদীর পাড়ে গিয়ে আঘাত করছে। সেখানে বালুর স্তর বেশি থাকার কারণে নদীর স্রোত এবং ঢেউয়ের আঘাত বালুর স্তরের সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। তাই পাড় ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হচ্ছে।

বর্তমানে ভয়াবহ নদী ভাঙনের কবলে পড়ে দেশের কয়েকটি জেলার মানুষ দিশেহারা। নদীগর্ভে একের পর এক বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের বসতঘর, অট্টালিকা, হাট-বাজার, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, সড়ক, ব্রিজ, ফসলি জমি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনা। রাক্ষুসে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ অনেক নদীই এখন বেপরোয়া গতিতে ভেঙে নিচ্ছে জনপদের পর জনপদ। নদীর ভয়াবহ ক্ষুধা যেন কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে পদ্মার ভাঙন এখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। তাতে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়ার মানুষ এখন ভাঙনকবলিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। যাদের বাড়িঘর এখনো ভাঙেনি, তারা তাদের বসতঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের একসময় ছিল অর্থবিত্ত, তারা এখন মাথা গোঁজার জায়গা জোটাতে পারছে না। পদ্মার গতিপথ পরিবর্তনের কারণেই স্বরণকালের ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে এ জেলার নড়িয়ায়। মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় অট্টালিকা, স্কুল-কলেজের ভবন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়ছে এখন মহাবিপাকে। প্রকৃতির প্রতিশোধে নিরণœ মানুষগুলো এখন বিপন্ন হতে বসেছে। নদী একূল ভাঙে ওকূল গড়ে। এতদিন পদ্মার ভাঙনে পদ্মার উত্তর পাড়ের জেলা মুন্সীগঞ্জের মানচিত্র ছোট হয়ে এসেছে। মুন্সীগঞ্জ থেকে অনেক আগেই বিদায় হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। তার মধ্যে ছিল কেদার রায় এবং চাঁদ রায়ের স্থাপনা। বর্তমানে পদ্মার উত্তর অংশ মুন্সীগঞ্জের পাড়ে বিশাল চর জেগে উঠেছে। তাতে ভাঙন কিছুটা কমে এসেছে। তবে দোহার-নবাবগঞ্জ অংশ এখনো ভাঙছে। একদিকে নদীতে চর জেগেছে অন্যদিকে পদ্মা ব্রিজের নদী শাসন ব্যবস্থার কারণে পদ্মা সেতুর প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী পূর্ব অংশের দিকে নদীর গতি পথ পরিবর্তন সাধিত হয়ে ভাঙন তা-বলীলা চালাচ্ছে। ভাঙনের প্রধান কারণ প্রবল স্রোত। এ এলাকার জন্য সরকার নদী ভাঙন প্রতিরোধে ১১ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলোÑ পদ্মার নদী দিয়ে কয়েকটি আঞ্চলিক নদীর পানি মেঘনা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। কয়েকটি নদীর প্রবল পানির চাপে যে তা-বলীলা শুরু হয় তাতে, ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী শাসনের জন্য মাঝ নদীতে ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু পদ্মার মাটি কেটে তা আবার নদীতেই ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিরাট প্রকল্প দুর্নীতিবাজদের কারণে তা আর আলোর মুখ দেখছে না। বিগত কয়েক বছরে জিও ব্যাগ ফেলে নদী ভাঙন রোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদার কত বস্তা ব্যাগ ফেলেছে তার হিসেব রাখার মতো কেউ নেই। তাই নদী শাসন রোধ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি হরির লুট চলে। কারণ, এখানে কোনো সাক্ষী-প্রমাণ থাকে না। একবার কিছু ব্যাগ ফেলতে পারলেই ঠিকাদার বিল উঠিয়ে নিতে পারেন। আর পানির নিচে কত ব্যাগ গেল, তা খোঁজ করার যৌক্তির কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে মাদারীপুরের আড়িয়াল খাঁর ভাঙনও শুরু হয়েছে। পদ্মার শাখা নদী হলো আড়িয়াল খাঁ। পদ্মার স্রোত গিয়ে পড়ে আড়িয়াল খাঁ নদীতে। সেখানে মাদারীপুর জেলার কালকিনি এখন ভাঙনের শিকার হয়ে অনেক মানুষ পথে বসে গেছে। অন্যদিকে ভাঙন শুরু হয়েছে রাজবাড়ী জেলায়ও। সেখানে পাঁচটি ইউনিয়নে ভাঙন চলছে। তবে সবচেয়ে হতাশার খবর হলোÑ বরিশালের শিলাইদাহ কুঠিবাড়ী বাঁধ ধসে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও ঠিকাদার কোম্পানি নিয়মনীতি মেনে কাজ না করায় এবং কাজে বড় ধরনের দুর্নীতি থাকায় বাঁধ ধসে পড়েছে। দেশে অন্যান্য ছোট নদীও এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে চীনে ভয়াবহ বন্যার পানি ছেড়ে দেওয়ায় তা ভারত হয়ে এখন আমাদের দেশের নদীতে এসে পড়ছে। তিস্তা এবং পদ্মা নদীর পানি এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোতে নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো ক্ষতির মুখে পড়তে হবে নদীপাড়ের মানুষকে। পানির স্রোতে ভাঙন আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

সরকার যায় সরকার আসে, কিন্তু তাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রাকৃতির নিষ্ঠুর খেয়ালের কারণে তাদের জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাময়। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চল এলাকাটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। সেখানে ভাঙনের শিকার অনেক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে শহরের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। দীর্ঘ কয়েক দশকে পদ্মার নড়িয়া ও তার আশপাশ ভাঙতে ভাঙতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। নাসার প্রতিবেদনে পদ্মার নড়িয়ার নদী ভাঙনের পুরো চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ৫১ বছরে ৬০০ কিলোমিটার নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। দীর্ঘ কয়েক দশকেও কাক্সিক্ষত এবং কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমানের পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে পড়েছে। ১৯৬৭ সাল থেকে পদ্মা নদী ভাঙন শুরু হলেও ১৯৯৮ সালে হঠাৎ করে তা বেড়ে যায়। বিশেষ করে পদ্মার উজানের ফারাক্কার পানি ছেড়ে দেওয়ায় বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙন শুরু হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি এবং নদীপাড়ের পরিবর্তন ধরা পড়ে নাসার ক্যামেরায়। স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৭ বছরেই নড়িয়া উপজেলার ১৩ বর্গকিলোমিটিারের চেয়ে বেশি নদী ভাঙনের শিকার হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে নদী ভাঙতে থাকে। তবে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ভাঙনের শিকার হেেছ আধা বর্গকিলোমিটার, কিন্তু ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে আবার তা বাড়তে থাকে। তখন ভাঙছে ২ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। তাদের গবেষণায় বলা হয়েছেÑ ভাঙনের কবলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার সম্পদ।

নদী শাসনের জন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আগে তৈরি করতে হবে বড় ধরনের রোড ম্যাপ। তারপর সেনাবাহিনী দিয়ে মহা কর্মযজ্ঞ শুরু করা না গেলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কোনো উপকারের আসবে না নদীপাড়ের মানুষের। এদিকে উত্তরাঞ্চলের যমুনা নদী এবং তিস্তায়ও চলছে ভয়াবহ নদী ভাঙন। সেখানকার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বালুর বস্থা ফেলে প্রাথমিকভাবে ভাঙন রোধ করা চেষ্টা চালাচ্ছে। তাতে ভয়াবহ ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো সেখানে কাজ শুরু হয়নি বলে নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বসতভিটা থেকে শুরু করে ফসলি জমি। যমুনা নদীর প্রকল্পটি যদি সঠিক সময়ে নেওয়া যেত তাহলে হয়তো ভাঙন থেকে কিছু মানুষকে রক্ষা সম্ভব হতো। দেশের নদী ভাঙনের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সরকারিভাবে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। তাদের মাথা গোঁজার জন্য নিতে হবে বড় প্রকল্প। জীবন ধারণের জন্য কর্মসংস্থান তাদের বড় একটি দাবি। জলাশয় ভরাট করে তা বিপন্ন করা হলে তার জন্য রয়েছে আইনের দ-। কিন্তু ক্ষমতাশালীরা এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। তারা শুধু পুকুর-জলাশয়ই ভরাট করছে না, কোনো কোনো নদীর অংশও ভরাট করে ফেলছে। তাই বর্ষা মৌসুমে তীব্র স্রোতের কারণে একের পর এক ভাঙছে জনপদ। সরকারও দীর্ঘদিন ধরে নদীগুলোকে ড্রেজিংযের আওতায় আনছে না। পানি প্রবাহের জন্য গভীর নদীর প্রয়োজন। তাতে নদীর পাড় সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু দায়সাড়া গোছের কিছু নদী খনন করা হলেও দেশের অনেক নদীই এখন ভরাট হয়ে পড়েছে। তাই সরকার যদি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাধ নির্মাণ করেন তাহলে তাতে কোনো ধরনের কার্যকর এবং ফলদায়ক হবে না। আমাদের নদীর পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতা তৈরির জন্য নদীগুলোর গভীরতা তৈরি করতে হবে। তার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close