আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

চামড়াশিল্পে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ

চামড়াশিল্পে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কিছু ট্যানারি মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ শিল্পের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সম্ভাবনাময় এ শিল্পে অপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঘটছে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ। অনেক শিশু নিয়োজিত রয়েছে এ শিল্পে। শিশুসহ এ শিল্পের জড়িত অনেকে চামড়াসহ বিভিন্ন রোগে ভোগে। অনেকের অকালমৃত্যু হয়। এ শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না হওয়ায় বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর আশপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে মাটি ও বায়ু। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেক ক্ষুদ্রশিল্পের কারখানায় ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হয়ে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে।

রফতানি পণ্য তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে পাট ও চায়ের পর অনিবার্যভাবে যে পণ্যটির নাম চলে আসত, তা হলো চামড়া। তবে আমাদের চামড়া খাত বাজার ধরতে পারছে না। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের ট্যানারি বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের(এলডব্লিউজি) মানসনদ দিচ্ছে না। বিশ্বের ৬৬টি বড় ব্র্যান্ডের সদস্য। এলডব্লিউজি মান সনদহীন ট্যানারি থেকে তারা চামড়া কেনে না। পরিবেশ সুরক্ষা, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় সনদের ক্ষেত্রে। বিশ্বের ৪৪০টি কারখানা এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে ২৪২টি গোল্ড সনদ। ভারত ১০৫টি, চীন ৭৫টি, ব্রাজিল ৬৩টি, ইতালি ২৬টি, ভিয়েতনাম ১৪টি, পাকিস্তান ৩টি, বাংলাদেশ ১টি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া খাতের সার্বিক রফতানি আয় কমেছে। কয়েক বছর ধরে বৃদ্ধির প্রবণতার পর গত বছরই এ খাতে রফতানি আয় কমেছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের রফতানি আয় ক্রমেই বাড়ছে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা অনেক সংস্থার জরিপের চিত্র খুবই ভয়াবহ। পৃথিবীর ২০ কোটি মানুষ প্রতিদিন সরাসরি পরিবেশ দূষণের ক্ষতি মোকাবিলা করছে। ভারী ধাতুর কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে আর ইলেকট্রনিক আবর্জনা জমছে নদীতে। ‘গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশন’ সংস্থার পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদনে এ রকম অনেক বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে চামড়াশিল্পে যারা কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই ৫০ বছর হওয়ার আগে মারা যান। ট্যানারির বিশাক্ত পরিবেশে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া কাজ করার কারণেই তাদের এ পরিণতি। আর এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। জরিপের এ ফলাফল আমাদের দৈন্যতার কথা বলে।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের ট্যানারিগুলো। সংখ্যার বিচারে কম করে হলেও ২২০টি ট্যানারি তো হবেই। আর এসব ট্যানারিতে কাজ করেন অন্ততপক্ষে ২৫ হাজার শ্রমিক। ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহার করা হয় ক্রোমিয়াম, খার এবং অ্যাসিড। শ্রমিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া খালি পায়ে এবং খালি হাতে এই প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন। ফলে ক্যানসারও চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন তারা, যা তাদের অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। শুধু তা-ই নয়, এখানকার বর্জ্য আশপাশের পরিবেশও দূষিত করে। ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা দূষিত করছে বুড়িগঙ্গার পানি, ট্যানারি এলাকার মাটি ও বায়ুকে। শ্রমিক ছাড়াও সে এলাকার বাসিন্দাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে শিশুরা, যারা এ শিল্পে কাজ করছে, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। কারখানায় ব্যবহৃত সালফিউরিক অ্যাসিড, ক্রোমিয়াম এবং সিসা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তার ওপর এসব কারখানায় কোনো বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’-ও। বিশেষজ্ঞরা বলেন, চামড়াশিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই ট্যানারিতে শ্রমিকরা যেভাবে খালি গায়ে ও খালি হাতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন, তাতে এই রাসায়নিক প্রবেশ করে তাদের ফুসফুসে ও চামড়ায় ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা দিতে পারে। শুধু ট্যানারি নয়, তাদের কেন্দ্র করে ছোট ছোট আরো অনেক অপরিকল্পিত কারখানা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। সেসব কারখানায় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য, যেমন টুকরো চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি, দাঁতÑএগুলো পুড়িয়ে পোলট্রি ফিডসহ আরো নানা জিনিস তৈরি করা হয়। এসব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো এলাকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ট্যানারি এবং ওইসব ছোট ছোট কারখানার কারণে পুরো সে এলাকার মানুষ, মাটি, পানি এবং বাতাস এখন বিষে আক্রান্ত। আর এর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গাও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। অথচ জীবন ও পরিবেশের ক্ষতি করে, এমন ট্যানারির ব্যবসা কিন্তু ঠিকই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ট্যানারির মালিকরা শ্রমিকদের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করালেও, মজুরি দেয় কম।

ট্যানারিশিল্পে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। একটি ট্যানারির ভেতরের চিত্র ভয়াবহ। ঢাকায় ট্যানারি রয়েছে, যাতে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এসব ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহৃত হয় ক্রোম পাউডার, কপার সালফেট, সোডিয়াম, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, অ্যাসিড, ব্লিচিং পাউডারসহ নানা রকম রাসায়নিক। শ্রমিকরা নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া খালি হাত-পায়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ করার ফলে চর্মরোগ তাদের নিত্যসাথি। এ ছাড়া রাসায়নিকের প্রভাবেও অন্যান্য রোগে ভোগেন নি¤œ আয়ের শ্রমিকরা। বাংলাদেশের চামড়াশিল্প নিয়ে বড় অভিযোগ হলো, এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং এখানে অবাধ শিশুশ্রম দেখা যায়। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের চর্মশ্রমিকদের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয়। ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ হাজারিবাগ এলাকায়ই প্রায় ৯০ ভাগ চামড়াশিল্প রয়েছে। এখানকার শিল্প-কারখানাগুলো বছরের পর বছর মাটি, পানি, বাতাস বিষাক্ত করছে। ঢাকার অদূরে সাভারে চামড়াশিল্পের জন্য আলাদা শিল্প এলাকা তৈরি করা হলেও, সেখানে যেতে আগ্রহ নেই অধিকাংশ শিল্প মালিকদের। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরের পর থেকে দক্ষিণ ঢাকাসহ বুড়িগঙ্গার পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যহানির মারাত্মক কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। বর্তমানে চামড়াশিল্পে ২২০টি ট্যানারি, চামড়াজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে ৩৫০টি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং ১১০টি মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প জড়িত রয়েছে। ২২০টি ট্যানারির মধ্যে প্রায় ১০০টি কারখানা উন্নতমানের লেদার প্রস্তুত করে থাকে। তবে এই ট্যানারিগুলো প্রায় বেশির ভাগই হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত। এই ট্যানারি কারখানাগুলো নিতান্তই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে।

জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা গেছে, হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে দৈনিক ৭৭ লাখ লিটার তরল বর্জ্য ও ৮৮ টন কঠিন বর্জ্য উদগত হয়। ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। এ ছাড়া বংশাল, সিদ্দিকবাজার, লালবাগ, নাজিরাবাজার, আলুবাজার, পাগলা, নওয়াবপুর এলাকায় বিভিন্ন ছোটখাটো জুতা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠায় পরিবেশ দূষণে প্রভাব ফেলছে। পরিবেশগত কারণের জন্যই এপেক্স ছাড়া বাংলাদেশের কেউ আন্তর্জাতিক সনদ পায়নি। ফলে বিশ্ববাজারে আমরা চামড়াশিল্পে পিছিয়ে পড়ছি।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close