ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

নদীভাঙনের অভিশাপ

নদীভাঙন বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যা এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সর্বনাশা ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য ফল হিসেবে বাংলাদেশে নদীভাঙনের ঘটনা বেড়েছে। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও তিস্তা পারের হাজার হাজার মানুষ নদীভাঙনের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে।

শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলায় পদ্মার ভাঙন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। একনেকে এ এলাকার নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সময়মতো বাঁধ তৈরির কাজ শুরু না হওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর-শাহজাদপুর, কাজীপুর ও চৌহালী উপজেলার যমুনা তীরবর্তী মানুষের। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণ, আড়কান্দিসহ প্রায় ছয়টি গ্রামের সহস্রাধিক বসতভিটাসহ কয়েক শতাধিক হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চৌহালীর স্থলচর-খাসপুকুরিয়া-বাঘুটিয়া ইউনিয়নে স্বল্প আকারে ভাঙন শুরু হলেও আতঙ্ক কাটছে না তিনটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।

শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, জামিরতা, ভাটপাড়া এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। কাজীপুরের কয়েকটি ইউনিয়ন ভাঙনের কবলে রয়েছে। পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে ফরিদপুরের সদরপুর ও চরভদ্রাসনের অবস্থা ক্রমেই ভয়াল আকার ধারণ করছে। গত এক মাসে পদ্মা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়নের একাংশ বিলীন হয়েছে নদীতে। এখনো ভাঙন অব্যাহত থাকায় নদীপারের হাজারো মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে যে নদীতে পানি ছিল না, সেই তিস্তা উজান থেকে আসা পানিতে প্রমত্ত রূপ ধারণ করেছে। নদীভাঙনে উজাড় হয়ে যাচ্ছে শত শত একর জমি ও ঘরবাড়ি। বাংলাদেশে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ নদীভাঙনে সর্বস্ব হারায়। এ সর্বনাশের হাত থেকে নদীতীরের মানুষকে রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। নদী শাসনের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি।

নদীভাঙনের কবলে পড়ে বছরে গৃহহীন হচ্ছে সোয়া লাখ মানুষ। নদীভাঙন একটি নিয়মিত ঘটনা এ দেশে। একে ঘটনা না বলে দুর্যোগ হিসেবেও অভিহিত করা যায়। নদীর একূল ভাঙে আর ওকুল গড়ে। এটি তার চিরাচরিত ধর্ম। নদীমাতৃক এই দেশে নদীর সঙ্গে যেমন মিশে আছে কোটি কোটি মানুষের জীবন; তেমনি এই নদী মানুষের সর্বনাশের কারণও। বিশেষ করে নদীভাঙন ও বন্যা মানুষের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। নদীভাঙন যেন চিরায়ত বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। দেশের অসংখ্য নদী রয়েছে। যেগুলোয় ভাঙন হয় সারা বছর। এই ভাঙনের ফলে নদীতে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ।

আমাদের জন্য একটা নিয়মিত দুর্যোগ হচ্ছে নদীভাঙন। আর এই নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। দেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত পটভূমিতে নদীভাঙন একটি চলমান সমস্যা। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে দশ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর আশ্রয়হীন হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজার। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে প্রধান চারটি নদীতেই ভাঙন বেশি। নদীগুলো হচ্ছেÑপদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও গঙ্গা। এর বাইরে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোট-বড় নদীর বেশিরভাগই ভাঙন হচ্ছে সারা বছর।

নদীর তীর ধসে পড়া বা তীর ভাঙন একটা স্বাভাবিক নিয়ম। তবে এর পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমত, বলা যায়, বাংলাদেশ পলিগঠিত ব-দ্বীপ হওয়ায় পানির সামান্য তোড়েই নদীর তীর ভেঙে যাচ্ছে। তা ছাড়া, পলি ও বালুতে নদীগুলো ভরাট হয়ে পড়ায় বর্ষায় এসব নদী পানি ধারণ করতে পারে না। তখন দুই কূল চেপে উপছে পড়ে পানি। সৃষ্টি হয় বন্যা। আর এ অবস্থায়ই নদীর তীরে ভাঙন সৃষ্টি হয়। আবার নদীর স্বাভাবিক গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ফলে অনেক নদীতে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নদীর তীরে বাঁধ দিলে বা রাস্তাঘাট নির্মাণ করলেও নদীভাঙন দেখা দেয়। অযৌক্তিক ড্রেজিং, নদী খনন ও বালু উত্তোলনের জন্যও নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীভাঙনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নদীভাঙন বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের প্রসার ঘটাচ্ছে।

নদীভাঙনের ফলে নানামুখী সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নদীর নাব্য হ্রাস। কারণ, নদীভাঙনের ফলে নদী ভরাট হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে বন্যার প্রকোপ। নদীভাঙনের ফলে দেশের বড় নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। প্রতি বছরই কমছে নৌপথের দৈর্ঘ্য। এখন ভরা বর্ষা মৌসুমেও নৌপথের দৈর্ঘ্য ছয় হাজার কিলোমিটারের কম। তা ছাড়া, নদীভাঙনে মানুষের গৃহহীন হওয়ার ঘটনা তো আছেই। তাই এই ভাঙনরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close