মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

আশুরার তাৎপর্য ও মর্মবাণী

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। আর মুহররম মাসের ১০ তারিখই আশুরা নামে অভিহিত। অনেকগুলো তাৎপর্যম-িত ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল। দিনটি ইসলামের ইতিহাসে খুব গুরুত্বের দাবিদার। হজরত আদম (আ.)-এর তওবা মহররমের দশম দিন তথা এই আশুরায় কবুল হয়েছে। বর্ণিত আছে, তিনি দীর্ঘ ৩০০ বছর কান্নার পর আশুরার দিন তাঁর তওবা কবুল হয়। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। এ দিনে হজরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে (বর্তমানে আরারাত পর্বত শ্রেণিতে) এসে স্থির হয়। (মুসনাদে আহমদ)। আল্লাহ তাআলা হজরত ইদ্রিস (আ.)-কে আশুরার এ দিনে উঁচু মর্যাদায় আসীন করেন। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আশুরার দিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং আল্লাহ তাআলা এ দিনে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন ও আগুন থেকে মুক্তি দেন। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। হজরত ইউসুফ (আ.) এ দিনে জেল থেকে মুক্তি পান। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর উম্মতকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। (মুসলিম)। এ দিনে হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। (তাম্বিহুল গাফিলীন)। এই দিনেই হজরত সোলাইমান (আ.)-কে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বাদশাহী দেওয়া হয়েছিল। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। এ দিনে হজরত ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। আরশ, কুরসি, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, তারকা, বেহেশত এ দিনেই সৃষ্টি করা হয়েছে। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। এ দিনেই সর্বপ্রথম আসমান থেকে জমিনে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। (তাজকিরাতুল কুরতুবি)। আশুরার দিন পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামও রোজা রাখতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল রোজায় পরিণত হয়। এ দিনেই হুজুর (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, বেহেশতি যুবকদের সরদার হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন।

এভাবে যতগুলো ঘটনা এদিনে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে, সবগুলোই সমগ্র উম্মাহর জন্য, গোটা মানবজাতির জন্য ছিল রহমত। আর এরই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ছিল সিয়াম পালন। ইহুদিরা কেবল আশুরার দিনেই সিয়াম পালন করত। প্রিয়নবী (সা.) ইহুদিদের ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে ইসলামী ইবাদতের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে আশুরা দিবসের সঙ্গে নবম দিবসেও সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নবম ও দশম মহররমের রোজা রাখো এবং ইহুদিদের খেলাফ করো অর্থাৎ তাদের মতো কেবল একদিন সিয়াম পালন করো না।’ মোটকথা, খিলাফতে রাশিদা পর্যন্ত সমগ্র উম্মাহর মধ্যে এ দিনটিকে তাৎপর্য ও মর্মবাণী উল্লিখিত ঘটনাবলির ভেতরই সীমিত ছিল। আর এ কারণেই দিনটিকে মুসলিম জাতি পবিত্র ও বরকতময় মনে করেন। ৬১ হিজরির এ দিনটিতেই এমন একটি ঘটনা সংঘটিত হয়, যা উল্লিখিত সব ঘটনাকে ছাপিয়ে ওঠে দিনটিকে একটি অনন্য ও স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য দান করে। আর তা হলো, এ দিনেই রাসুলে আরাবি প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কলিজার টুকরা হজরত হুসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মম ও নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করেন।

হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) সমঝোতাক্রমে মুসলিমজাহানের এককভাবে খিলাফত লাভ করেন এবং পরে ২০ বছর একাধিক্রমে খিলাফত পরিচালনা করেন। অতঃপর তিনি তার ছেলে ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সবাই এ মনোনয়ন মেনে নিলেও যে কয়েকজন সিংহদিল আল্লাহর বান্দা তা মেনে নিতে পারেননি। তাদের মধ্যে হজরত হুসাইন (রা.)-এর নাম ছিল সর্বাগ্রে। তিনি ইয়াজিদকে স্বেচ্ছাচারী, অযোগ্য ও অপদার্থ হিসেবে খলিফা হওয়ার সর্বাংশে অনুপযুক্ত মনে করেন। তার হাতে বায়আত করতে অস্বীকার করেন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) তার জীবতকালে এ বিষয়ে হজরত হুসাইন (রা.)-এর ওপর কোনোরূপ পীড়াপীড়ি না করার নীতি মেনে চললেও তার ইন্তেকালের পর তৎপুত্র ইয়াজিদ সে নীতিকে উপেক্ষা করে বায়আতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এমতাবস্থায় হজরত হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায় মক্কায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফায় আগমনের আহ্বান ও তার প্রতি সর্বপ্রকার সাহায্য-সমর্থনের দৃঢ় আশ্বাসসূচক অসংখ্য চিঠি হাজির হয়। তাদের আহ্বান ও সাহায্য-সমর্থনের আশ্বাস কতটা আন্তরিক, তা সরেজমিনে দেখার জন্য তিনি আপন চাচাতো ভাই হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.)-কে কুফায় পাঠান। হজরত মুসলিম (রা.) কুফায় অনুকূল পরিবেশ লক্ষ করে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফায় আগমনের সবুজ সংকেত দেন। ইয়াজিদ পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে কুফার গভর্নর নুমান ইবনে বশীরের স্থলে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে নিযুক্ত করেন। এদিকে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফার পথে অবরোধপূর্বক যেকোনো মূল্যে বায়আত গ্রহণের নির্দেশ দেন। উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফায় ক্ষমতার বাগডোর হাতে নিয়েই হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.)-কে হত্যা করে এবং একদল সৈন্য প্রেরণপূর্বক হজরত হুসাইন (রা.)-এর আগমনে বাধা দেয়। একপর্যায়ে উভয় কাফেলা কারবালা নামক স্থানে উপনীত হয় এবং সামনাসামনি অবস্থান গ্রহণ করে। হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.) শাহাদাতের পূর্বেই হজরত হুসাইন (রা.)-কে বিশ্বস্ত লোক মারফত কুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অবহিত করে পেছনে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে যান। কিন্তু হজরত হুসাইন (রা.) ‘তাকদিরের লিখন অখ-নীয়’Ñএই বলে হাসিমুখে সব অবস্থা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তার কুফা গমনে বাধাদানকারীদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত আবদুলœাহ ইবনে উমর (রা.), হজরত আবু সাইদ আল খুদরী (রা.), হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), হজরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যাব (রা.)-এর মতো প্রমুখ সাহাবি ছিলেন।

ইতোমধ্যে আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে ইবনে জিয়াদ প্রেরিত আরো একটি বিরাট বাহিনী ময়দানে এসে উপস্থিত হয়। এদের প্রতি ইবনে জিয়াদের নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে বায়আত গ্রহণের। হজরত হুসাইন (রা.) এবং তার আত্মীয়-বান্ধব ও মুষ্টিমেয় সাথি অন্যায়ের সামনে মাথা নত করার বিপরীতে সত্য রক্ষায় শাহাদাতকে অগ্রাধিকার দেন। সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। ইয়াজিদ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষিপ্ত হলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আসলে এ ছিল যুদ্ধের নামে এক অসম যুদ্ধ। সুসজ্জিত চার হাজার বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলিয়ে নারী-শিশু বাদে মাত্র ৭২ জনের একটি ক্ষুদ্র দলের এ যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। হজরত হুসাইন (রা.) ও তাঁর আত্মীয়-বান্ধবরা কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে ন্যায়ের জন্য নীতির কাছে একটি পরম ও প্রিয় সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর পিয়ারা হতে চেয়েছিলেন। পরে বংশধরদের জন্য একটি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মহত্তম নজির সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা উম্মাহকে এমনিভাবে মহত্তর আদর্শ ও লক্ষ্যের জন্য কোরবানি পেশ করতে অনুপ্রাণিত করবে। আর এখানেই তাদের সাফল্য। যুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.) ও তাঁর আত্মীয় সবাই শাহাদাতবরণ করেন। সেনানায়ক শিমারের নির্দেশে হুসায়ন ইবনে নুমায়ের হজরত হুসাইন (রা.)-কে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর তাঁর কণ্ঠে বিদ্ধ হয়। যুরআ ইবনে শুরায়ক তামীমি তরবারি দ্বারা তাঁর কাঁধে আঘাত করে। অবশেষে সানান ইবনে আনাস নামক চরম হতভাগা নেজার আঘাত হানলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। অতঃপর সে তার তলোয়ার দিয়ে হজরত হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র মস্তক, যেই মস্তক বিশ্বস্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিনের সামনে ছাড়া আর কখনো নত হয়নি, পবিত্র দেহ মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

হজরত হুসাইন (রা.) ছিলেন এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যার প্রশংসা করেছিল ইবনে জিয়াদের সামনে। স্বয়ং তারই হত্যাকারী সানান ইবনে আনাস। সে বলেছিল, ‘স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে আমার বাহন পূর্ণ করে দাও। কারণ, আমি এমন একজন নেতাকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন সৌন্দর্যম-িত। আমি হত্যা করেছি এমন এক ব্যক্তিকে যিনি মাতা-পিতার দিক দিয়েও উত্তম এবং অতি উত্তম বংশজাত, যাদের নাম স্মরণ করা হয় তাদের মধ্যে সর্বোত্তম। ইবনে জিয়াদ শত্রুর এই প্রশংসা সইতে পারেনি। তক্ষণি নিজের হাতে তাকে হত্যা করে। আর এভাবেই দুনিয়ার বুকে এই পাপিষ্ঠ হতভাগা তার কৃতপাপের শাস্তি লাভ করে। স্থূল দৃষ্টিতে কারবালায় ইয়াজিদের জয় হলেও প্রকৃত বিজয় হজরত হুসাইন (রা.)-এর ও তাঁর আদর্শেরই হয়েছিল আর পরাজয় ঘটেছিল ইয়াজিদের। বৃক্ষের জন্য পানি যেমন জাতির জীবনে রক্ত, তেমনি সঞ্জীবনী সুধা বিশেষ। হজরত হুসাইন (রা.) ও তাঁর সাথিবর্গ মুসলিম উম্মাহর জন্য রক্ত ঢেলে সেই সঞ্জীবনী শক্তিই জুগিয়ে গেলেন। যার প্রবাহ আজও আমরা আমাদের শিরা-উপশিরায় অনুভব করি।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close