রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

প্রাপ্তি ও প্রত্যাশায় বিস্তর ফারাক

একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতি একটি বড় চালিকাশক্তি। সে অর্থব্যবস্থার ভিত যদি সুদৃঢ় হতে না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের পক্ষে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করা দুরূহ ব্যাপার। তাই প্রয়োজন স্থিতিশীল অর্থব্যবস্থা। আর যে দেশের প্রতিটি সেক্টর দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতি বছর শীর্ষস্থান দখল করে নেয়, সে দেশে স্থিতিশীল অর্থব্যবস্থার প্রত্যাশা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কী হতে পারে? মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মায়েদের এ কথাগুলো শুনেই আমরা বড় হয়েছি। পড়ালেখা শেষ হলে চাকরি খোঁজেন এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। উদ্যোক্তা হতে চাইছেন খুব কম। যদিও এ উদ্যোক্তা হওয়ার মতো পরিবেশের যথেষ্ট ঘাটতি এখনো বিদ্যমান। প্রথামাফিক মানসিকতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি বলেই ‘সোনার হরিণের’ খোঁজে পথে নামে সবাই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেশে এ মুহূর্তে (২০১৬-১৭ হিসাব অনুযায়ী) ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ আর কর্মহীন আছেন ২৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। গত বছরের তুলনায় তা ৮০ হাজার বেশি, অর্থাৎ প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছেন প্রায় এক লাখ বেকার। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বেশি। মোট বেকারের ১১.২ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত, সংখ্যায় তিন লাখের ওপর। ৩৬তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি ইস্যু হয়েছিল ২০১৫ সালের ৩১ মে। আবেদন জমা পড়েছিল দুই লাখেরও বেশি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা শেষে ২ হাজার ৩২৩ জনের পক্ষে সুপারিশ দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর। এখন ২০১৮ সালের জুলাই মাস চলছে। অর্থাৎ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। যারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং কোনো কাজে আছেন তারা কি কোনো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারবেন? আর দুই লাখ থেকে ২ হাজার ৩২৩ জন নিয়োগের অনুপাত এটাই বলে এ দেশে আমরা কতটা চাকরির সংকটে আছি।

বিগত বছরগুলোয় যে হারে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে, এতে সরকারি চাকরির প্রতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবকদের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং যৌক্তিক। সেই তুলনায় বেসরকারি পর্যায়ে চাকরির নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা কম। জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে (জানুয়ারি, ২০১৮) জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানান, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শূন্যপদের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি। মন্ত্রণালয়, আওতাধীন দফতরসমূহের মধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদ ৪৮ হাজার ২৪৬টি। দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্য পদ ৫৪ হাজার ২৯৪টি। তৃতীয় শ্রেণির শূন্য পদ ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৭টি এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদসংখ্যা ৭৩ হাজার ৯৮৪টি। নিয়োগ বন্ধ আছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। মামলা এবং নানামুখী ভুল সিদ্ধান্ত এর জন্য দায়ী। বেকারদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন উন্নত জীবনের আশায়। উল্লেখ্য, প্রতিযোগিতার বিশ্বে টিকে থাকার জন্য দক্ষতা ভীষণ প্রয়োজন। এই ৪৮ শতাংশ যদি পেশাজীবী হতো তাহলে এ দেশের প্রতিবিম্ব একেবারেই ভিন্ন হতে পারত। বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সে আমাদের অর্থনীতি এখনো শক্ত অবস্থানেই আছে। কিন্তু এ সুযোগে দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা দেশ ত্যাগ করছেন, যা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তা ছাড়া শ্রম ও পেশা নির্বাচন নিয়ে আমাদের খুঁতখুঁতে ভাবনার পেছনে আছে পাছে লোকে কিছু বলে ও সামাজিক মর্যাদা। কাজ কে ছোট করে দেখছি আমরা। বর্তমানে ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮৫টি। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে দুটি। বিশেষায়িত ইঞ্জিনিয়াারিং বা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে ১০টি, যেখান থেকে বিএসসি সনদ দেওয়া হয়। এ মুহূর্তে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩০টি, আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৬৫টি। গণহারে কলেজ সরকারি করা হয়েছে, অথচ শিক্ষকদের মান নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু বিষয়ভিত্তিক বিভাগ আছে, যা পড়ে আমরা অর্জন করি স্নাতকের সনদ, যার বাস্তব বা প্রায়োগিক কোনো ক্ষেত্র এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। তাহলে কেন পড়ানো হচ্ছে এসব বিষয়? আমাদের অনেক পরিবারেই এমন চিত্র বিদ্যমান। সঠিক পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনার অভাবে আমাদের অগুণতি তরুণ আজ বিভ্রান্ত এবং হতাশায় নিমজ্জিত। প্রতি বছর ২০ লক্ষাধিক মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে হচ্ছে না। এই ব্যবধান ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পড়ালেখা শেষ করে একটি তরুণ যখন প্রতিবন্ধকতা কিংবা নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তখন তাদের অধিকাংশই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। এর মূল কারণ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির করুণ ব্যবধান।

শিক্ষানীতি কোনো অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। কোনো ভুলত্রুটি হলে তা সংশোধন করা যাবে। বর্তমান শিক্ষানীতির সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, যথার্থতা ও জাতীয় মর্যাদা লাভের আরেকটি পরিমাপক হলো এর বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিলক্ষিত না-হওয়া। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো শিক্ষাও একটি প্রধান মৌলিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্র ও সরকার এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, বাংলাদেশের সংবিধানে এ-নিরিখে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। এ-ছাড়াও ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে শিক্ষালাভে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য না করার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মহান সংবিধানের ২৮ ও ৪১ অনুচ্ছেদে। তা ছাড়া সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে সীমিত সম্পদের মধ্যেও যে মহৎ কিছু করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০। ঐকমত্যের ভিত্তিতে, সব শ্রেণিপেশার মানুষের মতো ও পরামর্শ ধারণ করেই প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে এ শিক্ষানীতি।

অন্যসবের বিপরীতে বাস্তবায়নের মধ্যেই রয়েছে এর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা। শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর সমান সুযোগপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা শিক্ষানীতির একটি মৌলিক দর্শন। মানবিক ও নৈতিকমূল্যবোধসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কর্মমুখী মানবসম্পদ বিনির্মাণে সহায়ক গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা রয়েছে এ-শিক্ষানীতিতে। মৌলিক অধিকার হিসেবে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যে রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব, তার প্রতিফলন ঘটেছে এর পাতায় পাতায়। তবে দায়িত্বের সঙ্গে দায় আছে। এ দায় আর্থিক দায়। আর্থিক দায় বহন ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে কী? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই।’ মূলত আমাদের কথা, কাজ ও চাহিদাÑএসবের মধ্যে প্রয়োজন অধিকতর সামঞ্জস্য, সমন্বয়; গরমিল বা হেরফের নয়। আর হেরফের থাকলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আবদার হিসেবেই থাকবে। কবিগুরুর ‘শিক্ষার হেরফের’ শীর্ষক প্রবন্ধ এ ক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে : ‘আমাদের হেরফের ঘুচিলেই আমরা চরিতার্থ হই। শীতের সহিত শীতবস্ত্র, গ্রীষ্মের সহিত গ্রীষ্মবস্ত্র কেবল একত্র করিতে পারিতেছি না বলিয়াই আমাদের এত দৈন্য, নহিলে আছে সকলই। এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাই আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’

যদি প্রত্যাশিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সমাজের কোনো পরিবর্তন করতে না পারে তাহলে সে ভালো দিয়ে কী হবে? স্বপ্নচারীর মতো স্বপ্ন দেখা নেহায়াৎ বোকামি, যদি সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার কোনো প্রচেষ্টা অব্যাহত না থাকে। ৪৩ বছরের দুর্যোগের ঘনঘটা আর নানা অপ্রাপ্তিতে আমরা বেদনাহত হই, মুষড়ে পড়ি। এরপরও অজানা এক শক্তিতে বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আমাদের তাড়িত করে। আমাদের ১৬ কোটি মানুষকে যদি জাগাতে পারি, ঘুণে ধরা সমাজের সব অনাচারা শুধরে নিতে পারি, নৈতিক শিক্ষার বলে বলিয়ান করতে পারি; তাহলে আমারাই হব আমাদের তুলনা। সেই বিশ্বাসে আমাদের পথ চলা হোক দুর্বার, দুর্দমনীয়, অপ্রতিরোধ্য। এসবের পরও বলব, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close